ঈদসংখ্যা ২০২২

পাঁচ দেশের ৫টি ফ্ল্যাশ ফিকশন

শেষ সিম্ফনি ।। অগাস্টো মন্টেরোসো, গুয়াতেমালা

এবং আপনারা জানুন, বেশ মোটাসোটা এক ব্যক্তি ভিড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে বলছিল, ‘তিন বছর আগে গুয়াতেমালায় গির্জার পাশে থাকা একজন বয়স্ক যন্ত্রশিল্পী আমাকে বলেছিলেন যে ১৯২৯ সালে তাঁকে লা মার্সেডে সঙ্গীতের কিছু পাণ্ডুলিপি তালিকাবদ্ধ করতে বলা হলে অকস্মাৎ তিনি কিছু অসঙ্গতি দেখতে পান কারণ পৃষ্ঠাগুলো তাঁকে প্রচণ্ড কৌতূহলী করেছিল এবং তিনি অসম্ভব নিষ্ঠার সাথে সেগুলো অধ্যয়ন করতে শুরু করেন যেহেতু মার্জিনে নোটগুলো জার্মান ভাষায় লেখা ছিল সে-কারণে অসমাপ্ত সিম্ফনি দুটোর চড়া সুর বুঝতে তাঁর বেশ সময় লেগেছিল তবে আমি একদম স্পষ্টভাবে খোদ শ্যুবার্টের করা স্বাক্ষরটা দেখার পর তাঁর তীব্র আবেগটা কল্পনা করতে পারি এবং তিনি তাঁর এই আবিষ্কারের কথা জানাতে প্রচণ্ড উত্তেজনায় রাস্তায় ভোদৌড় দেন কিন্তু সবাই তা দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে এবং তারা বলে যে তিনি সম্বিত হারিয়েছেন এবং তাদের সাথে প্রতারণা করতে চেয়েছেন কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন যে শেষ দুটো সুরের আন্দোলন প্রথম দুটোর মতোই দুর্দান্ত ছিল আসলে তাঁর নিজের দক্ষতা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন ফলে মনোবল হারাননি বরং শপথ করেছিলেন যে তাঁর এই আবিষ্কারের বৈধতা পেতে এবং তা মানুষকে বিশ্বাস করাতে বাকি জীবনটাই উৎসর্গ করবেন এবং সে-কারণেই তিনি গুয়াতেমালার প্রতিটি সঙ্গীতশিল্পীকে পদ্ধতিগতভাবে চ্যালেঞ্জ জানান কিন্তু প্রত্যেকটা উদ্যোগই ব্যর্থতার চূড়ান্ত হয় এরপর কাউকে এমনকি তাঁর স্ত্রীকেও কোনো কিছু না বলে তিনি তাঁর বাড়ি বিক্রি করে ইউরোপে চলে যান এবং ভিয়েনায় থাকার সময় তাঁর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে ওঠে আর এইসব ঘটনার পর লোকেরা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলাবলি করতে থাকে যে কোনও গুয়াতেমালার লেইরম্যান* তথা বাদ্যকারের কাছে তাদের আসলে শেখার কিছু নেই যেখানে শ্যুবার্টের সমস্ত হারিয়ে যাওয়া কর্মের অন্বেষণে শহরজুড়ে পণ্ডিতরা ছড়িয়ে রয়েছেন উপরন্তু তারা লোকটার সেই বাড়ি থেকে আনা শেষ পৃষ্ঠাগুলোর ব্যাপারে বিরূপ হয়ে ওঠে এরপর লোকটা তাঁর ফিরতি পথের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করে বুয়েনস আইরেসের স্প্যানিশ ভাষী এক বয়স্ক ইহুদি পরিবারের সাথে দেখা করেন এবং তিনি লক্ষ করেন যে তারা খুব মনোযোগসহ তাঁর কথা শুনছে কিন্তু তাদেরকে খুব উত্তেজিত মনে হয় কারণ তাদের বিশ্বাস পিয়ানোতে ভায়োলা ও ভায়োলিনের ওই সুর দুটো তোলার কৌশলী ধাঁধাটা কেবল ঈশ্বরের পক্ষেই ভেদ করা সম্ভব এবং শেষপর্যন্ত তারা সেই ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সেগুলো নাকের কাছে নিয়ে শুকে শুকে ঘ্রাণ নিতে থাকে তারপর জানালা দিয়ে আসা আলোর কাছে উচিয়ে ধরে এবং শ্যুবার্ট রচিত পৃষ্ঠা তারা প্রথমে খুব শান্তভাবে স্বীকারও করে কিন্তু পরক্ষণেই সেগুলো শ্যুবার্টের! বলে বিশাল চিৎকার ধ্বনি দিয়ে ওঠে এবং হতাশা নিয়ে একে অপরের কাঁধে ভর দিয়ে এমনভাবে কান্না করতে থাকে যেন তাঁকে হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলোর পরিবর্তে তাদের কান্নার দিকেই অধিক মনোযোগী হতে হয় যদিও পরে তারা কিছুটা প্রশান্ত হয়েছিল এবং নিজেদের ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলার চেষ্টা করছিল এবং তারা তাদের হাত একসাথে ঘষছিল তাঁকে এটাই বোঝানোর জন্য যে সুর দুটো আসলেই দুর্দান্ত কিন্তু সেগুলো নাকি সিম্ফনির মূল্যে কিছুই যোগ করেনি বরং কেউ কেউ বলতে পারে যে সেগুলো বরং মূল জায়গা থেকে সরে গেছে আর লোকেরা ছিঁড়ে ফেলা সেই শ্যুবার্টের কিংবদন্তির গল্পেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে কারণ তাদের স্থির বিশ্বাস সেই হারানো সুর দুটো কখনই প্রথম দুটোর সমান হবে না বা তাদের গুণমানকেও ছাড়িয়ে যাবে না আর একথা তো শ্যুবার্ট নিজেও তাদেরকে লিখে জানানোর চেষ্টা করেননি উপরন্তু তারা ভাবছিলো যে এইভাবে ‘allegro’ ও ‘andante’ হয় আর এগুলো ঠিক ‘scherzo’ ও ‘allegro ma non troppo’-এর মতোই এখন কথা হচ্ছে যদি তিনি সত্যিই শ্যুবার্টের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা করেন তবে সবচে বুদ্ধিমানের কাজ হবে তাদের প্রচলিত সংগীতকেই সংরক্ষণ করা কারণ এই সত্যটি ছাড়া তা হবে এক অন্তহীন বিতর্কের বিষয় আর যা কিছুই হারাবে তা শ্যুবার্টের বলে পরিগণিত হতে থাকবে এবং তিনি নিশ্চিত যে এই বর্বরদের মধ্যে কখনও কিছু অর্জন করা সম্ভব নয় কারণ শ্যুবার্টের ভক্তদের তুলনায় ব্যাপারটা আরো বেশি খারাপ ছিল ফলে তিনি আর বিলম্ব না করে গুয়াতেমালায় ফিরে যান এবং একবার নৈশভ্রমণের সময় জাহাজের ফেনাযুক্ত অংশে পূর্ণ চাঁদের আলো প্রতিফলিত দেখতে দেখতে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন আসলে ভালো-খারাপ বিচিত্র মানুষের সাথে লড়াই করতে করতে গভীর দুঃখে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এরপর তিনি পাণ্ডুলিপিটি হাতে নেন আর কস্মিনকালেও কেউ যাতে খুঁজে না পায় সেভাবেই তিনি একের পর এক পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে ফেলেন।’ তীব্র বিষণ্ণতার একটি সুর বেজে ওঠে—‘প্রবল অশ্রু তাঁর গাল বেয়ে নেমে আসছিল আর তাঁর অন্তর পুড়ে যাচ্ছিল এবং তিনি যারপরনাই তিক্ততা নিয়ে ভাবছিলেন যে তিনি বা তাঁর দেশ আর কখনও সেই ছেঁড়া পাতাগুলো পৃথিবীতে ফিরে পাবার গৌরব দাবি করতে পারবে না যা এ-বিশ্বে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গৃহীত হওয়া উচিত ছিল কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।’

(প্রায় যতিচিহ্নহীন ব্যতিক্রমী গল্পটি এডিথ গ্রসম্যান-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর করা হলো।)


যখন একটি ডলার এক বড় চুক্তি ছিল ।। আরি বেন, নরওয়ে

বাড়ন্ত দাঁড়িমুখো লোকটা আমেরিকা ভ্রমণ করতে থাকে। সে আর্থার র‌্যাঁবো পড়ত, কবিতা লিখত। নিউইয়র্ক থেকে লস এঞ্জেলেসে বাস ভ্রমণের সময় পলাতক এক মেয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়। চাইল্ডকেয়ারের লোকজন তার পিছু নিয়েছে বলে মেয়েটি জানায়। তার মা ছিল একজন নেশাগ্রস্ত নারী। সৎবাবা তাকে সাংঘাতিকভাবে মারত। শয়তান লোকটা তার জঙ্ঘায় প্রচণ্ড আঘাত করে। পরদিন সকালে নক্সভিলে নামার সময় দাঁড়িমুখো লোকটাকে সে তার বাবার ঠিকানা দেয়। সেই ছোট্ট চিরকুটটা হাতে নিয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত সে বাসের মধ্যে অপেক্ষা করে। লস অ্যাঞ্জেলেসের বাড়ি থেকে পালানোর পর লাসভেগাস ভ্রমণের সময় সমস্ত ডলার সে হারিয়ে ফেলে। এরপর মোজাভে মরুভূমিতে হিচহাইকিং করতে থাকে। নরওয়ে ফিরে টেনেসিতে নামা সেই মেয়েটার ঠিকানায় সে একটা চিঠি লেখে, ‘তুমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সত্যি এক অভূতপূর্ব ঘটনা’, তারপর সে লেখে, ‘আমরা কি একসঙ্গে থাকতে পারি না…?’ তিন সপ্তাহ পর ওই চিঠির জবাব আসে। খাম জুড়ে বড় বড় হরফে লেখা ‘অজ্ঞাত ঠিকানা’। আমেরিকার ডাকবিভাগ ফিরতি ডাকমাশুল পরিশোধ করে। এটাও বড় বড় হরফে লেখা ছিল। যেন একটা ডলার সত্যি অনেক বড় ঘটনা।

(রবার্ট ফার্গুসনের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর)


আমেরিকা স্ট্রিট ।। লিলি পটপাড়া, স্লোভেনিয়া

অ্যাপার্টমেন্টটা সপ্তাহখানেক ধরে নীরব। বাবা-মার সঙ্গেও কথা হচ্ছে না। আজও তারা দুজন কাজে ব্যস্ত। নিঃসঙ্গ মেয়েটি আপন মনেই যেন খেলায় মত্ত। খেলাটি এমন–সে নিজেই কথা বলে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে এবং ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠে উত্তর দেয়। মা সকাল সকাল বাড়ি এসে হাঁক ছাড়ে, ‘আলেঙ্কা, রান্নাঘরে আয়।’

অ্যালেঙ্কা তার খেলনাগুলোর কাছে ক্ষমা চায় এবং দ্রুতই ফিরে আসবে বলে কথা দেয়। মা বলল, ‘আলেঙ্কা, তোকে আমার কিছু বলার আছে।’

মায়ের ওই রূপ দেখে অ্যালেঙ্কা ভয় পায়, যেন সে ভুল দেখছে। তাকে বলল, ‘তোর আব্বু তোকে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিয়েছে। একটা সাইকেল, মানে, রগ পনি ফোল্ডিং বাইসাইকেল।’

অ্যালেঙ্কা কিছু বলে না, তবে কিছু একটা তার মনকে বিষিয়ে তোলে। সে খুব রেগে যায়। তার বয়স শীঘ্রই এগারো হবে, সে মোটেও আর ছোট শিশুটি নয়। একখানা সাইকেল এখন তার পরম ধ্যান। দীর্ঘদিন ধরে সে এমন একটা বাইক চাচ্ছিল, যাতে চড়ে সিলভা ও ক্যাটারিনার সাথে পাশের ছোট্ট রাস্তা ‘আমেরিকা’য় যেতে পারে। বাইক ছাড়া তা আসলেই অনেক দূর। এ নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে অনেক কল্পনাও করে এবং কথা বলে, যেমন—ঢালগুলো কত্ত খাড়া, কীভাবে নিচের ব্রেকে শক্তভাবে পা রাখতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। সে অবশ্য চায় যে তারা অন্য কিছু নিয়েও কথা বলুক। 

আম্মুর মুখে তখনো রাগের ছায়া, ‘আলেঙ্কা, তোর খুশি হওয়া উচিত। তোর আব্বু বাইকটা কেনার জন্য রীতিমতো ধার করেছে।’ 
‘তাই! আম্মু!’ 
সে তার খেলনা নিয়ে জানালার দিকে ফিরে যায়। 
‘ওয়াও! আমি সারপ্রাইজ হিসাবে একটা বাইক পেতে যাচ্ছি,’ বলে সে খেলনাগুলো ওপরে-নীচে অবিরত লাফাতে থাকে। 

জন্মদিনে আলেঙ্কার পেটে ব্যথা হয়। তবুও সে স্কুলে যায় এবং ক্লাসে বসে বাইকটি লাল কি নীল তা নিয়ে ভাবতে থাকে। অন্য বাইকগুলো নীল বা লাল, শুধু সিলভারটাই গোলাপি। কারণ তার বাবা এটি রং দিয়ে এঁকেছে।

দুপুরের খাবারের পর বাবা বাড়ি এলে তাকে নিচে আসতে বলে। অ্যালেঙ্কা নেমে আসে এবং হালকা নীল রঙের একটা বাইক দেখতে পায়। সে তার বাবার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। তার সুখি হওয়ার কথা, কিন্তু তার পেটব্যথা আরো বেড়ে যায়। সে বাইকটা স্পর্শ করে, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা একটু অস্বস্তিকর বটে। 

‘ধন্যবাদ, আব্বু,’ বলে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তার খেলনাগুলো নিয়ে সে ওপরে উঠে যায়।

‘তুমি তাহলে রাইড করতে যাচ্ছ না?’—বাবা জিজ্ঞেস করে। 
কী করা উচিত বুঝতে না পেরে অ্যালেঙ্কা জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, এই তো কিছুক্ষণের মধ্যেই।’ 

নিচতলাটা এমনিতেই অপরিসর। ক্ষীণ আলোয় তা আরো সংকীর্ণ লাগে। বাবা কতো বড় আর অ্যালেঙ্কা কত্ত ছোট! সে যেন নড়াচড়া করতে পারে না। ‘ধার’ শব্দটা কেবল তার কানে বাজতে থাকে। সে মনে মনে চায় তার বাবা চলে যাক, যাতে সিলভা ও ক্যাটারিনা নিঃসঙ্কোচে তার কাছে আসতে পারে আর সে ‘আমেরিকা’ স্ট্রিটে পালিয়ে যেতে পারে।

(ক্রিস্টিনা জেড্রাভিচ রেয়ার্ডন-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর)


পরিহাস ।। জিয়ানিস পালাভোস, গ্রিস

স্ক্রু ড্রাইভারটা নিচে আনে স্ট্যাভ্রস।
‘হয়ে গেছে,’ সে বলল, ‘এসো দেখে যাও।’
ক্যাটেরিনা তোয়ালে হাত মুছতে মুছতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। 
‘ওটা কী?’
‘লিফটের চিহ্ন।’
বাথরুমের দরজায় লেখাটার দিকে তাকালো ক্যাটেরিনা :
‘সতর্কতা : প্রবেশ করার আগে নিশ্চিত হবেন যে গাড়িটি দরজার পেছনে অবস্থান করছে এবং সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়েছে।’

‘এটা আমি আজ সকালে আবর্জনার মধ্যে খুঁজে পেয়েছি,’ স্ট্যাভ্রস বলে, ‘ভাবলাম মজা করে এটা এখানে ঝুলিয়ে দেই।’ ক্যাটেরিনা মাথা নাড়ে। তারা ছয় মাস একসঙ্গে ছিল। কিন্তু একবারও সে তার কোনো মজার কাণ্ড দেখে হাসেনি।
ক্যাটেরিনা জিজ্ঞেস করল, ‘আমি কিছু ভাজাভুজি করেছি, খাবে?’

মার্চের শেষে স্প্রিং সেমিস্টারের মাঝামাঝি স্ট্যাভ্রসের বাবা কিছু টেস্টের জন্য হাসপাতালে যান। তার লিভারের ক্যান্সার ধরা পড়ে। ভাগ্যক্রমে সেটা প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। স্ট্যাভ্রস মাস দেড়েকের জন্য তার গ্রামের বাড়ি ফিরে যায়। সে-সময় তার মা হাসপাতালে ছিল আর সে সংবাদপত্র স্ট্যান্ডের যত্ন নিতে। এরপর থেসালোনিকিতে ফিরে আসে। সে তার ঘরে এক আগন্তুককে দেখতে পায়।

‘এ হচ্ছে ভিসেন্টে’, ক্যাটেরিনা তাকে জানায়, ‘সে কিছুক্ষণ আমাদের সাথে থাকবে। আশা করি তোমার কোনো সমস্যা নেই।’

ভিসেন্টে বয়সে এক বছরের বড়। সে বার্সেলোনা থেকে গ্রিসে আগত ইরাসমাস এক্সচেঞ্জে স্থাপত্যের ছাত্র। তিন সপ্তাহ আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনসার্টে ক্যাটেরিনার সঙ্গে তার দেখা হয়। পরদিন তারা একত্রিত হয়। 

স্প্যানিশ লোকটি মুদি দোকানে কিছু কেনাকাটার জন্য জন্য বাইরে যায়। এই ফাঁকে ক্যাটেরিনা স্ট্যাভ্রসকে জড়িয়ে ধরে। স্থাপত্যের ছাত্রদের ওপর সে কতখানি দুর্বল তা উন্মাদনার সঙ্গে বলতে থাকে। স্পেনে ফিরে যেতে তাদের আর মাত্র মাস দুয়েক বাকি। এতো দেরিতে তাদের দেখা হওয়াটা মোটেও ভালো হয়নি। তাকে ছাড়া সে কীভাবে বাঁচবে? বইয়ের তাক থেকে সে একটা পিগি পুতুলওয়ালা ব্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁকায়। বলে, ‘সেপ্টেম্বরে বিমান ভাড়ার জন্য আমি সঞ্চয় করছি।’ 

এদিকে স্ট্যাভ্রস তার স্যুটকেস খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করে—
‘তোমার বাবা কেমন আছেন?’
‘হ্যাঁ, ভালো। ধন্যবাদ।’

ভিসেন্টে ফিরে এলে সে তার ব্যাগ নিয়ে ক্যাটেরিনার ঘরে যায়। সে আসলে বেশ কৌশলী। একদিকে অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ ছোট, অন্যদিকে স্ট্যাভ্রসকে অসুবিধায় ফেলার জন্য তার খুব খারাপ লাগছিল। দুজন স্কুলে পড়ার সময় সে রঙ-বেরঙের হাড়ি-কড়াইয়ে খাবার চড়াত। সিঙ্কটা ঝকঝকে পরিষ্কার কি না সেটাও দেখে নিশ্চিত করত। রাতের বেলা তারা সবাই সিনেমা দেখত। কখনও কখনও একসঙ্গে কারাওকে গাইত। কাতালোনিয়ায় অন্য সবাই যা করত আরকি! স্ট্যাভ্রস বাড়িতে থাকার সময় তারা কখনই নিজেদেরকে বোকা বানায়নি। এমন যদি ঘটতও, স্ট্যাভ্রস অন্তত কিছু মনে করতো না। তারা খুবই শান্তশিষ্ট ছিল। এমনকি লোকটা বাথরুমের দরজায় লিফটের রসিকতা পছন্দ করত। 

‘মুয়ে বিন, স্ট্যাভ্রস’ বলে সে একটা হাঁক দেয়। তারপর তার পিঠে মৃদু একটা চাপড় মারে। কতোগুলো সপ্তাহ যে কেটে গেল! কোনও কোনও সময় স্ট্যাভ্রস তাকে পছন্দ করত। বলতে গেলে এই পছন্দের মাত্রাটা বেশি হবার কথা নয়। কারণ সেও ক্যাটেরিনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। আসলে প্রথম দিন থেকেই তারা একসাথে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে।

এই সম্পর্ক বা তার অনুভূতি সম্পর্কে স্ট্যাভ্রস কোনো কথা বলেনি। পক্ষান্তরে নতুন প্রেমিক হারাবার ভীতি নিয়ে ক্যাটরিনাকে সে সান্ত্বনা দেয়। পানাহারে বাইরে যাবার সময় সে প্রেমিক যুগলের সাথে যায়। 

স্প্যানিশ লোকটি চলে যাওয়ার দিন দুই আগে গত শনিবার তারা তিনজন মিলে কেরকিনি লেকে বেড়াতে যায়। স্ট্যাভ্রস গাড়ি চালায় আর ভিসেন্টে পেলিকানদের ছবির পরে ছবি তোলে। মালাউইতে ক্যাটেরিনার চাচার মালিকানাধীন এক গ্রিক রেস্টুরেন্টে তাদের খাবারটাও সেরে নেয়। ওর চাচা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর একজন স্বেচ্ছাসেবক। ভিসেন্ট স্টাভ্রসকে বলছিল—কীভাবে তাকে সে মিস করবে। এমন সময় ওয়েটার বিল নিয়ে আসে। মানিব্যাগ খুঁজতে গেলে স্ট্যাভ্রস তাকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বাধা দেয়। ‘না, প্লিজ।’ ভিসেন্টে জোর দিয়ে বলে, ‘নিমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি সত্যি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।’

রবিবার সন্ধ্যায় তারা বসার ঘরে একটি বিয়ার ও কাইসার ভাগ করে নেয়। প্রথমে ক্যাটরিনাকে শান্ত মনে হয়েছিল, কিন্তু পরক্ষণই সে কাঁদতে শুরু করে। ভিসেন্টও কাঁদতে থাকে। স্টাভ্রস তাদেরকে রেখে একা বারান্দায় যায়। ঘাম ঝরাতে সে তার বিয়ারটিও সাথে নিয়ে যায়। বেলা ২টা বাজে স্প্যানিশ লোকটি তার জিনিসপত্র জড়ো করতে থাকে। স্ট্যাভ্রসকে সে বিদায় সম্ভাষণ জানায়। ভিসেন্টে যাবার আগে ক্যাটেরিনার সঙ্গে ঘরে নিজেকে আটকে রাখে। 

স্ট্যাভ্রস শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। পাশের ঘরে তখন চলছে অন্যরকম ঘটনা। প্রথমে তারা কাঁদছিল, তারপর আবার কাঁদছিল। এই প্রথম সে বিছানায় তাদের কথা শোনে। যখন তারা শেষ করে, তখন আবার কান্না শুরু হয়, কিন্তু এবারের কান্না ছিল আরও বেশি চাপা। অন্ধকারে স্ট্যাভ্রস যেন তাদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। মাত্র তিন ফুট দূরে দেয়ালের ওপারে সে তাদের অবস্থা কল্পনা করে। এর চুলে ওর হাত আর ওর হাত যেন এর বুকের ‘পর। 

স্ট্যাভ্রস বমি করতে চায়। প্রস্রাব করতে ওঠে একবার। কিন্তু বাথরুমের দরজা খোলার পর সবই অদৃশ্য হয়ে যায়।

(পরিহাস, কারেন ভ্যান ডাইক-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর)


স্বপ্ন ।। নাগিব মাহফুজ, মিশর

টেলিফোনটা বেজে ওঠে। অপর প্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘শাইখ মুহাররম, তোমার শিক্ষাগুরু বলছি।’
আমি শ্রদ্ধায় বাতাসের মতো নুয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে উত্তর দেই, ‘হে, শিক্ষাগুরু, আপনাকে স্বাগত অভিবাদন।’

তিনি বললেন, ‘আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছি।’ 
উত্তর দেই—‘আপনাকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য আমি উন্মুখ।’

এ-ঘটনায় আমি বিন্দুমাত্র বিস্ময় অনুভব করিনি, যদিও প্রায় ষাট বছর আগে আমি তাঁর শবযাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমার পুরনো শিক্ষাগুরু সম্পর্কে কিছু অমলিন স্মৃতি যেন আমার কাছে ফিরে আসছিল। এই যেমন—তাঁর সুদর্শন মুখ, মার্জিত পোশাক, এমনকি ছাত্রদের সঙ্গে কিছু কঠোর নিয়মকানুনের কথাও স্মরণ হচ্ছিল। শাইখ তাঁর উজ্জ্বল জুব্বা, কাফতান ও সর্পিল পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় প্রত্যক্ষগোচর হলেন। তিনি বিশেষ কোনো ভণিতা ছাড়াই উচ্চারণ করলেন, ‘সেখানে, আমি প্রাচীন কবিদের সঙ্গে বসবাস করছি। তারা ধর্মের ব্যাপারেও বিশেষজ্ঞ। তাঁদের সঙ্গে বাক্যালাপের পর বুঝতে পারি যে, আমি তোমাকে যেসব পাঠ্যবস্তু শেখাতাম সেগুলোর কিছু সংশোধনী প্রয়োজন। আমি তোমার জন্য এই কাগজে সংশোধিত পাঠসমূহ লিখে নিয়ে এসেছি।’

এই বলে টেবিলে একটি ফোল্ডার রেখে তিনি অন্তর্হিত হলেন।

(রেমন্ড স্টক কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তর)