রফিক আজাদ

নগর নৈঃসঙ্গ্য ও মধ্যরাতের কবি

রফিক আজাদনগর, নৈঃসঙ্গ্য ও আধুনিক মানুষের জীবন যন্ত্রণার আরক-স্নাত কবি রফিক আজাদ অস্তি ও নেতিচেতনার দোলাচল হতে জন্ম দেন দুর্দান্ত কবিতার সোনালি শস্য। ষাটের দশকের বাংলা কবিতার আকণ্ঠ বিবমিষা ও হতাশা তার হাতে পেয়ে যায় মাদকতাময় এক কাব্যভাষা। স্যাড জেনারেশনের অন্যতম প্রবক্তা এই কবি জীবনকে মেপেছেন দুঃখ আর যন্ত্রণার চামচে। T. S Eliot এর J. alfred prufrock-ও জীবনকে মেপেছিলেন কফির চামচে– I have measured out my life with coffee spoons.

ষাটের দশকে আবির্ভূত রফিক আজাদ (জন্ম: ১৯৪৩) বিষয়গত দিক থেকে একদিকে যেমন সমসাময়িক সমাজ জীবন সময়ের মুখাপেক্ষী, তেমনি তিরিশ চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কাব্য-ঐতিহ্যের অনুসারী। এছাড়া পঞ্চাশের দশকের পশ্চিমবঙ্গের কবিদের দ্বারাও প্রভাবিত। পশ্চিমবঙ্গের ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার আদলে ষাটের দশকে ‘কণ্ঠস্বর’ ‘স্বাক্ষর’ ‘সাম্প্রতিক’ ‘প্রতিধ্বনি’ ‘বক্তব্য’ ‘যুগপৎ’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের ‘হাংরি জেনারেশন’-এর অনুসরণে ষাটের দশকে বাংলাদেশে ‘স্যাড জেনারেশন’-এর জন্ম ঘটে। অবশ্য ‘হাংরি জেনারেশন’ও সৃষ্টি হয়েছিল অ্যালেন গিন্সবার্গের (১৯২৬-১৯৯৭) ‘বিট জেনারেশনে’র প্রত্যক্ষ প্রভাবে। এই প্রভাব তার কবিতায় নতুনত্ব সঞ্চার করেছিল নিঃসন্দেহে। এই দশকের কবিরাও চৈতন্যগত দিক থেকে দুটি অংশে বিভক্ত ছিলেন– অবক্ষয়ী ও উজ্জীবনী এই দুই ধারায় ষাটের দশকের কবিতা আবর্তিত; যদিও এই দুটি বৈশিষ্ট্য বাংলা কবিতায় নতুন নয়।
তিরিশ, চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের কবিতায়ও এই প্রবণতাগুলো সহজলক্ষ। তবে এই কবিদের নতুনত্ব তাঁদের প্রকাশশৈলী, আঙ্গিক-পরিচর্যা ও আত্মতার পরিমিত সংমিশ্রণে, যা বাংলাদেশের কবিতাকে করে তুলেছিল সপ্রতিভ ও শিল্প সুশোভিত। রফিক আজাদ এই চেতনারই শক্তিমান ধারক ও বাহক। SAD GENERATION-এর অন্যতম কবি রফিক আজাদ নৈরাশ্য নৈঃসঙ্গ্য ও হতাশার তীব্র বোধ কবিতায় ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন– ‘এ সময়ে আমাদের রচনায় নৈরাশ্য ছিল। সেই এক সময় ছিল যখন বাংলা ভাষা আরবী হরফে লেখানোর ষড়যন্ত্র, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর হামলা, জোর করে আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে খতনা করার ষড়যন্ত্র, অপ্রচলিত আরবি ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা, বিএনআর, প্রেসট্রাস্ট, দাউদ আদমজী পুরস্কারের প্রতি লোভানো, ৬৫-এর যুদ্ধে পাকিস্তানের রণাঙ্গন দেখানোর ফাঁদ, প্রলোভন– তো এই যখন অবস্থা তখন আহ্লাদে আটখানা হয়ে আশাবাদের কবিতা লেখে কোন উন্মাদ?’ রফিক আজাদের নৈরাশ্যের কারণ এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাই তাঁকে অসহায় ও নিঃস্ব করে তোলে। SAD GENERATION-এর মূল কথাও হতাশা, নৈঃসঙ্গ্য, অসহায়তা ও মৃত্যুবোধ। ফলে সমসাময়িক সমাজবাস্তবতা ও তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে তাঁর কবিতা একটি বিশেষ স্থান অর্জনে সমর্থ হয়–


‘এটম বোমার থেকে দু’বছর বড় এই আমি
ধ্বংস ও শান্তির মধ্যে মেরুদূর প্রভেদ মানি না।
ক্ষীয়মান মূল্যবোধে, সভ্যতার সমূহ সংকটে
আমি কি উদ্বিগ্ন খুব? উদ্বিগ্নতা আমাকে সাজে কি?’
শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে রফিক আজাদশহীদ কাদরীর মতো রফিক আজাদও তীব্রভাবে বোদলেয়ার প্রভাবিত। দুজনই নগর-গণিকার কাছে শান্তির অন্বেষায় ছুটে যান। এছাড়া আত্মজৈবনিক অনুষঙ্গ রূপায়ণের ক্ষেত্রেও দুজনের মধ্যে সামঞ্জস্য লক্ষণীয়। তবে ভাষাপ্রয়োগ ও শিল্প-সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে রয়েছে উল্লেখযোগ্য দূরত্ব। রফিক আজাদ নিরাভরণ সারল্যে নিখুঁত অনুভবকে কবিতা করে তোলেন, অন্যদিকে শহীদ কাদরী ভাষা ও অলঙ্কার প্রয়োগের ক্ষেত্রে অভিজাত ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ। রফিক আজাদ বীট কবিদের মতো প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও আদর্শচেতনাকে ভেঙে দিয়ে নতুন সংবেদনা নির্মাণে সচেষ্ট। বুর্জোয়া মূল্যবোধকে নস্যাৎ করতে গিয়ে তিনি প্রবন্ধের ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। একই মনোভাব থেকে হোর্হে লুইস বোর্হেস (জন্ম: ১৮৯৯) Ficciones (১৯৪৪) গ্রন্থে প্রবন্ধের ভাষায় রচনা করেছিলেন গল্প। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় ও সমাজবাস্তবতা রফিক আজাদের ভাষাভঙ্গি ও বক্তব্যে নতুনত্ব যোগ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ, স্বাধীনতাপ্রাপ্তি ও পরবর্তী হতাশা কবিকে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতায় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিরন্ন মানুষের দীর্ঘ মিছিল কবিকে কতটা ক্ষুব্ধ ও অসহিষ্ণু করে তুলেছিল তা টের পাওয়া যায়–
‘দৃশ্য থেকে দ্রষ্টাঅব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো : গাছপালা, নদী-নালা
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা, তা-না হলে মানচিত্র খাবো।’
নগর ও নাগরিক অনুষঙ্গ রফিক আজাদের কবিতায় নতুন মাত্রা পেয়ে যায় অভিনব ভাষিক উষ্ণতায়। নাগরিক আবহাওয়ায় মানুষের অন্তর্গত নৈঃসঙ্গ তার কবিতায় সুগভীর ছায়া ফেলে যায়–
ফুটপাতের দুপাশে অলীক জনতা
তাদের অস্পষ্ট কথা, কথকথা
মুখ গুঁজে পড়ে থাকে বিমূঢ় বাতাসে
এখানে নগরের অলীক অবাস্তব পরিবেশ নতুন ভাষাভঙ্গিতে রূপায়িত হয়। নগরে বসবাসকারী মানুষগুলো এক সময় উন্মূল ও মনোলোকে উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। ফলে তাদের স্বকীয় অনুভূতিলোকেও দেখা দেয় দ্বৈততা ও নৈরাজ্য। কবির ভাষায়–
মানুষ আসলে ফুল পছন্দ করে না; তার চেয়ে
রুটি ও শব্জির গন্ধ ওরা বেশি ভালোবাসে। তবু
‘গোলাপ, গোলাপ’– বলে কান্না করা ওদের স্বভাব
‘শানকিতে শাদা ভাত’,‘ সবুজ সাম্রাজ্য, ‘পলিময় বীজতলা’, ‘আদিগন্ত বৃক্ষের বিস্তার’, ‘ব্যাপক খামার বাড়ি’ প্রকৃতির এসব উপকরণ নাগরিকের মনোলোকে জেগে থাকলেও বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন–
তুমি যেখানেই যাও
এসবের কিছুই পাবে না
সঙ্গে সঙ্গে যাবে এক বেতারগ্রাহক-যন্ত্র
নোংরা ড্রেন, পচা জল, হলুদ পত্রালি, ক্বাথ, চিমনির ধোঁয়া
দূষিত বাতাস আর গভীর রাত্রিতে ভারী বুটের আওয়াজ।
রফিক আজাদের কবিতায় ‘মধ্যরাত’ এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার প্রতীকী তাৎপর্যে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মধ্যরাত তার কাছে একদিকে যেমন নৈঃশব্দ ও নৈঃসঙ্গ্যের মূর্তিমান রূপ; অন্যদিকে সৃষ্টির অফুরন্ত সম্ভাবনাময় সূতিকাগার। তার কাছে ‘শিল্পীর জ্যেষ্ঠ সহোদর’ মধ্যরাত্রির সন্তান। চিত্রকর, দার্শনিক ও ধ্যানীদের তিনি মধ্যরাত প্রিয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কবির ভাষায়–
চিত্রকর, দার্শনিক, ধ্যানী– তোমার অনুজ যারা
তাদের কাছেও প্রিয় চাঁদহীন এই মধ্যরাত
কখনো কখনো মধ্যরাত কবির নৈঃসঙ্গ্যচেতনাকে আরও প্রগাঢ় করে তোলে। তিনি স্মৃতির অতলান্তে হাতড়িয়ে বেড়ান হারানো কোনো সুসময়, মাদকতাময় কিছু মুহূর্ত-শিশির– আমার নৈঃসঙ্গ্য আরো গাঢ় করে দিলো/স্মৃতিভারাতুর আলোয়-আঁধারে মোড়া এই মধ্যরাতে/ মনে পড়ে, মনে পড়ে যায়/ এমনি এক আলো-অন্ধকারময় রাতে/ প্রথমবারের মতো পাই সঙ্গমের স্বাদ/ মনে পড়ে/ আমার আনাড়ি হাতে ব্রা-র হুক খুঁজে পেতে/ দেরি হয়েছিলো–/ বিষণ্ন মধুর মধ্যরাতে এই পথ চলতে-চলতে/ সেই শিহরণ জাগে...
মধ্যরাত কবিকে নেশাগ্রস্তের মতো টানে, করে তোলে স্বীকারোক্তিপ্রবণ। রবার্ট লাওয়েল, সিলভিয়া প্লাথ প্রমুখ কনফেশনাল কবিদের মতো তিনিও আত্ম-উন্মোচন করে চলেন এই মধ্যরাতে। ‘কবি’ কবিতায় তিনি কবির যে প্রতিমূর্তি দাঁড় করান তাতেও আছে মধ্যরাতের এক দুর্মর প্রভাব–
ট্রাফিকবিহীন রাতে, মধ্যরাতে, শীতে
নিঃসঙ্গ হাঁটে সে ফুটপাতে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও অন্যান্যদের সঙ্গে রফিক আজাদ‘বহিরঙ্গে নাগরিক– অন্তরঙ্গে অতৃপ্ত কৃষক’ রফিক আজাদ তার মধ্যরাতপ্রীতি আর নাগরিক নৈঃসঙ্গ্য বুকে গেঁথে শেষ পর্যন্ত চুনিয়ার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন; যাকে তিনি আর্কেডিয়া মনে করেছেন। গ্রিক পুরাণে আর্কেডিয়া অখণ্ড শান্তির প্রতীক। আর্কেডিয়ার সমতলভূমিতে গ্রিসের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন জনপদ গড়ে উঠেছিল। ডোরিয়ান ও স্পার্টানদের আগ্রাসন প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে এখানকার জনগণ আর্কেডিযাকে শান্তির রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে আর্কেডিয়া গ্রিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির সূতিকাগার হিসেবে পরিগণিত হয়। কবির কাছেও চুনিয়া আর্কেডিয়ার মতোই ‘মনোরম আদিবাসী ভূমি’, যে ভালোবাসে ‘শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ’। চুনিয়া মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় অবলীলায়–
রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে।
চুনিয়ার এই শান্তিময় পরিবেশ স্বভূমিতে বিস্তারিত হোক এমন প্রত্যাশাই হয়তো কবির মনোগহীনে ক্রিয়াশীল ছিল।
কবি রফিক আজাদ তার স্বকীয় অনুভব ও অভিনব কাব্যভঙ্গির ঐশ্বর্যে বাংলাদেশের কবিতায় একটি উজ্জ্বল আসন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।