আন্দোলন-সংগ্রাম ও আনন্দ উৎসবের কেন্দ্রস্থল ঢাবির বটতলা

বিভিন্ন তর্ক-বিতর্ক শেষে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তোলার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। এরপর এ জাতির বিভিন্ন যৌক্তিক দাবি আদায়, অন্যায়ের প্রতিবাদে সব সময় সম্মুখ সারিতে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়।

বাঙালির ইতিহাসের কোনায় কোনায় জড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। বাঙালির আকাশ কখনও সাদা, কখনও কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। কালো মেঘের সেই দিনগুলোর সঙ্গে, বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের ঐতিহাসিক বটতলা। ছেষট্টির ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরে দেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই বটতলা। এছাড়াও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক-স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ সংগ্রামস্থল ছিল এটিই।

স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চক্ষুশূলে পরিণত হয় ঢাবি এলাকা। নির্বিচারে হত্যা করা হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বটতলাকে ভয় করতো। এ কারণেই ১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনী সবার অলক্ষ্যে ঐতিহাসিক বটগাছটি সমূলে উৎপাটন করে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে নতুন একটি বটগাছের চারা রোপণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কথা বলা একমাত্র মার্কিন  সিনেটর অ্যাডওয়ার্ড কেনেডি। কালক্রমে এ গাছটি এখন মহীরুহ। ওই প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাজের সমাবেশ নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়। কখনও প্রতিবাদ, কখনও আনন্দ উৎসব। বর্তমান গাছটির বয়স ৫০ বছর।

আগের গাছটির ইতিহাস আজও অজানা

বর্তমান গাছটির কথা জানা থাকলেও পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যে গাছটিকে সমূলে উপড়ে ফেলেছিল সেটির মূল ইতিহাস আজও অজানা। ওই গাছটি আসলে কে, কবে রোপণ করেছিল, তা জানা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বর্তমান গাছটির বয়স প্রায় ৫১ বছর। এর আগের গাছটি যুদ্ধের সময় উপড়ে ফেলে পাকিস্তানিরা। তবে গাছ কবে, কে রোপণ করেছিল, তা জানা নেই। আদৌ কেউ রোপণ করেছিলেন, নাকি প্রাকৃতিকভাবে জন্মেছিল, সেটাও জানা নেই।’

তবে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, আগের গাছটি কেউ রোপণ করেনি, প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছিল। তবে এখনকার গাছটি কেনেডি রোপণ করেন। তিনি কিছুটা একপাশে রোপণ করেন, পরে আমরা সরিয়ে বেদীর মাঝখানে রোপণ করি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বটতলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইতিহাসখচিত স্মৃতিফলক রয়েছে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায়। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছির। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি লক্ষ করেছি। এটি সংস্কার করার জন্য চারুকলার এক শিক্ষককে আহ্বায়ক করে কমিটিও করেছি। যে কোম্পানি কাজটা করেছিল, তাদেরও জানিয়েছি। খুব শিগগিরই এটি সংস্কার করা হবে।’

ঢাবি ৩

আবেগের কেন্দ্রে এই বটতলা

আন্দোলন, সংগ্রাম, বিভিন্ন দিবসের আন্দোলন উৎসব ছাড়াও এই ছায়াবৃক্ষ বটতলা শিক্ষার্থীদের কাছে আবেগের জায়গা। ক্লাসের আগে, ক্লাসের ফাঁকে, ক্লাস শেষে, ছুটির দিনে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডায়, গল্পে মেতে ওঠে। কেউ গিটার বাজায়, কেউ তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গলা খুলে গান ধরে। এভাবেই মেতে থাকে বটতলা। কোনও কোনও  শিক্ষার্থীর কাছে এটি রাতের বিশ্রামস্থল। সবকিছু মিলিয়ে এই বটতলা শিক্ষার্থীদের আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নুপুর আক্তার বলেন, ‘২ মার্চ, ১৯৭১ সালে ঢাবির কলাভবনের সামনে অবস্থিত বটতলায় এক ছাত্রসমাবেশে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়, যা মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণার উৎস ছিল। ’৬৯-এ ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের কেন্দ্রও ছিল এটি। সুতরাং এ কথা স্পষ্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটগাছকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সংস্কৃতির নিদর্শন বলা যায়। বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঢাবির ঐতিহাসিক বটতলা।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম বলেন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন পূর্ব পতাকা উত্তোলনসহ বিভিন্ন ইতিহাসের সাক্ষী এই বটতলা। এটা যেন আজও সংগ্রামী চেতনা ধরে রেখেছে। আজও আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যা ও সংকটে এখানে বিভিন্ন প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সমাবেশে হয়। এছাড়া এর ছায়াতলে কতশত মেধাবী পথিক বসেছে, বসছে, ভবিষ্যতেও বসবে। এটিকে একটি সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রও বলা যায়। সন্ধ্যার পর অনেকেই এখানে গলা ছেড়ে গান ধরেন, নানান সময়ে আয়োজন করা হয় কনসার্টও। তাই বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।

ঢাবি ২

‘প্রাকৃতিক এয়ারকুলার’ বটগাছ

জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে, পরিবেশকে বসবাস উপযোগী করে তোলে গাছ। আর বেশি পাতা বিশিষ্ট গাছ এক্ষেত্রে এগিয়ে। বটগাছের আয়ুষ্কাল, ডাল, পাতা, ছায়ার জন্য একে প্রাকৃতিক ‘এয়ারকুলার’ বলে অভিহিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মিহির লাল সাহা।

বটগাছের ইতিহাস নিয়ে তিনি জানান, এ গাছের জীবনকাল ২০০-৩০০ বছর। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব গাছ। আগে মূলত রাস্তার আশেপাশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মাতো। এই গাছ হিন্দু মিথোলজির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এছাড়াও মেলা, পহেলা বৈশাখ, বর্ষাবরণসহ বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই গাছ।

তিনি জানান, এই গাছ মূলত প্রকৃতির এয়ারকুলার, ছায়াদানকারী বৃক্ষ। এই গাছের ডালপালা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, অনেক পাতা হয়। আর বেশি পাতা বিশিষ্ট বৃক্ষ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশ ঠান্ডা রাখে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ গাছ আছে ঝিনাইদহে, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি পঞ্চম বা চতুর্থ। এই গাছ চুন-সুরকি অর্থাৎ ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ জায়গায় ভালো হয়।