কীটনাশকমুক্ত ধান উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি

দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) কীটনাশকমুক্ত ধান উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আজিজুল হকের নেতৃত্বে একটি গবেষক দল এ সাফল্য পেয়েছে।

ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৯২, ব্রি-৩৪ এবং জিরাশাইলসহ মোট ছয়টি জাতের ধানের ওপর গবেষণা চালিয়ে এই সফলতা পেয়েছেন তারা। প্লান্ট অ্যান্ডফাইটিক ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে এনে দ্বিগুণ ফলনের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে গবেষণা দলটি। ইতোমধ্যেই বেগুন ও টমেটো চাষে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারে সাফল্য পেয়েছেন তারা।

কৃষক ও গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রচলিত ব্রি-২৮ (বোরো) এবং ব্রি-৩৪ (আমন) জাতের ধানগুলো ব্লাস্টসহ অন্যান্য রোগের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল হওয়ায় ধানে অতিমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। এমনকি ধান ঘরে তোলার ১৫ দিন আগেও ব্লাস্ট প্রতিরোধের জন্য উচ্চমাত্রায় বিষ প্রয়োগ করতে হয়। এতে ধানের উৎপাদন প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কমে যায় এবং চালের নিউট্রিয়েন্ট ফর্টিফিকেশন ব্যাহত হয়। এ ছাড়া প্রতিবছর ইউরিয়া সার ব্যবহারে কৃষকের উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যা ইউরিয়া সার উৎপাদনেও সরকারের ভর্তুকি ও গ্যাসের ব্যবহার দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে। এই সমস্যার সমাধানেই গবেষকরা ইউরিয়া ও রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বায়ো ফার্টিলাইজার ব্যবহার করে ধান চাষ করেন।

গবেষকরা বলেন, ধান গাছ বৃদ্ধি করতে অ্যান্ডোফাইটিক ব্যাকটেরিয়া গাছের শিকড়, কান্ড, শাখা ও প্রশাখা বৃদ্ধির মাধ্যমে নাইট্রোজেনের বাড়তি জোগান বায়ুমণ্ডল থেকে সংগ্রহ করে। এতে ইউরিয়া সারের প্রয়োগ ৫০-৭০ শতাংশ কমানো সম্ভব। 

গবেষকরা জানান, এই গবেষণায় কিছু অ্যান্ডোফাইটিক ব্যাকটেরিয়ার মিশ্রণ তৈরি করা হয়, যারা অক্সিন হরমোন, এসিসি ডি-আমেনেজ এনজাইম তৈরি করে। এ ছাড়া তারা বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন ফিক্সেশন করে থাকে। এসব ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগে ব্রি-২৮ ধানের উৎপাদন গড়ে প্রায় ৫০-৫৫ শতাংশ বেড়েছে। সেই সঙ্গে ধানের খড়ে সেলুলোজ বৃদ্ধি পাওয়াতে খড়ের হার্ডনেস ২.০ গুণ বেশি বৃদ্ধি পায় এবং খড় অনেক সবল ও সুস্থ থাকে।

প্রধান গবেষক ড. আজিজুল হক বলেন, ‘আমরা মূলত তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছি। রাসায়নিক ও কীটনাশকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনা, অধিক ফলন এবং ধানের গুণগত মান বৃদ্ধি করা। ব্যাকটেরিয়া ব্যবহারে রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা হয়েছে। এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ। এ ছাড়া আমরা ধানের (ব্রি-৩৪) ফলন ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পেরেছি। গবেষণালব্ধ ধানের গুণগত মানও ভালো। এতে ধানে চিটার পরিমাণ কম হয়। এ ছাড়া ধানের শীষে পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান পাওয়া যায় এবং ধান নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কাটার উপযুক্ত হয়। এটি হাওড় অঞ্চলের মানুষদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।’

শুধু যে ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বায়োফার্টিলাইজার আবিষ্কার করেছে তা নয়, ওই ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনের নতুন কৌশল ও প্রযুক্তিও তৈরি করেছে গবেষক দলটি। তাই এখন থেকে কৃষি জমিতে বৃহৎ পরিসরে ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের জটিলতার অবসান ঘটিয়েছে গবেষক দলটি। ড. আজিজুলের নেতৃত্বে এই গবেষণায় সম্পৃক্ত হয়েছেন যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের ছাত্র তানভীর, শাহরিয়ার, মেহেদী ও রোকন। এতে খুবই অল্প খরচে কৃষক বাড়িতেই সাধারণভাবে ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে নিজেরাই ধানক্ষেতে প্রয়োগ করতে পারবে।

ড. আজিজুল হকের এই গবেষণায় আর্থিক সহযোগিতা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (আইআরটি)। সম্প্রতি গবেষক দলের সঙ্গে সরাসরি কৃষক পর্যায়ে গবেষণা ফিল্ড ভিজিট করেছেন আইআরটি পরিচালক প্রফেসর ড. এস এম হারুন-উর-রশিদ, কৃষি অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. বিধান চন্দ্র হালদার, সহযোগী গবেষক ড. ইয়াসিন প্রধান এবং অধ্যাপক ড. শাহ মইনুর রহমান।

এ সময় আইআরটি পরিচালক প্রফেসর ড. এস এম হারুন-উর-রশিদ বলেন, ‘আমরা সরাসরি মাঠ পরিদর্শন করে খুবই সন্তুষ্ট। আশপাশের জমির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম যেই জমিতে কৃষক ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগ করেছে সেখানকার ফলন কীটনাশক ব্যবহার করা জমির তুলনায় অনেক বেশি। আমরা কৃষকদের থেকেও খুবই সন্তোষজনক অনুভূতি পেয়েছি। সামনের বছরেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা ধান চাষ করতে চায়। আমি মনে করি এটায় আমাদের গবেষকদের বড় সাফল্য।’