ইপিজেডের বাইরে অন্যান্য সেক্টরে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন দৃশ্যত আছে মনে হলেও মালিক-সরকার-শ্রম দফতরের যোগসাজশে তা কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের। এ পরিস্থিতিতে ইউনিয়নগুলো শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে স্বীকার করেছেন খোদ ইউনিয়নের নেতারাই। তারা বলছেন, শ্রমিক অধিকার নিয়ে কেবল শ্রমিকরাই কথা বলবে এ ধরনের ভুল বক্তব্য ছড়িয়ে মালিকরা শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার কেড়ে নেন এবং কারখানায় ইউনিয়ন গড়ে তোলা হলেই কৌশলে সেই কারখানার নাম-ধাম পরিবর্তন করে ফেলেন। এ পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন আছে আবার নাই-ও বলা চলে। যেগুলো আছে তারা মালিকের সঙ্গে মিলে মালিকের স্বরে কথা বলতে পারে বলে অনেক শ্রমিক নেতা মত দেন।
আরও পড়ুন:
শ্রমিক নেতারা বলছেন, যে কোনও কারখানার ৩০ ভাগ শ্রমিক সম্মিলিত হলেই ওই কারখানার শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে। কিন্তু সেখানেও আছে গলদ। শ্রমিক ফেডারেশন নেতা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, তিনশ’ শ্রমিকের কারখানায় দেড়শ শ্রমিকের সম্মতি পেলেই ইউনিয়ন করতে পারার কথা। অথচ ইউনিয়নের আবেদন জমা দেওয়ার পর হুট করে মালিক ও শ্রম দফতরের কারসাজিতে শ্রমিক সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হয়,৩০ শতাংশ সম্মতি দিতে না পারায় অনুমতি দেওয়া গেল না। এ ধরনের কারসাজিতে পড়ে শ্রমিক তার অধিকার আদায়ের রাস্তা আর খুঁজে পান না।
বর্তমানে বাংলাদেশে রেজিস্ট্রার্ড ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা প্রায় ৫শ’ যার ৫০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মধ্যেই থাকে। বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে শ্রমিক নেতারা বলছেন, মালিকের দিক থেকে ব্যবসা মন্দার কারণ দেখানো হলেও আসলে ইউনিয়ন গঠন হলেই মালিক এধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ তিনি তার কারখানায় ইউনিয়ন থাকতে দেবেন না। এভাবে কারখানা বন্ধ করে মালিকের কী লাভ-এমন প্রশ্নের জবাবে তৌহিদুল বলেন, যে কারখানায় ইউনিয়ন গড়ে ওঠে মালিক সেই কারখানাটির ওই সুনির্দিষ্ট ইউনিট বন্ধ করেন কেবল ইউনিয়নকে এড়ানোর জন্য। এই ইউনিট বন্ধ করে নতুন নামে আলাদা ইউনিট খুলেন। এতে তার তো ক্ষতি নাই। আবার যেসব মালিক ইউনিয়ন তৈরি হোক কাগজে কলমে চান, তারা ইউনিয়ন তৈরি হওয়ার পর শ্রমিকদের ওপর চড়াও হন। উদাহরণ দিতে গিয়ে শ্রমিক নেতা জলি তালুকদার বলেন, ইউনিয়ন বানানোর আগেই যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের নামের তালিকা মালিকদের দিতে হয়। কিন্তু এই তালিকা দেওয়ার পরেই দেখা যায়, ইউনিয়নের গড়ার কাজে জড়িত শ্রমিকদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। তখন তারা আর সেই কারখানার শ্রমিক না থাকায় ইউনিয়নও করতে পারেন না। তিনি বলেন, মূল সমস্যা হচ্ছে মালিকরা ইউনিয়ন করতে দিতে চান না বলে মালিক পক্ষ, সরকার, শ্রম দফতর ও প্রশাসনের একটা যোগসাজস আছে। মালিক এবং সরকার পক্ষ শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার-সংক্রান্ত কোনও আইন মানতে রাজি নন।তিনি আরও বলেন, মালিকদের হয়ে,মালিকদের মতো করে কথা বলতে পারেন যারা তাদেরকে ঠিকই ইউনিয়নের অধিকার দেওয়া হয়। সেই ইউনিয়ন থাকা না-থাকা একই কথা। আর বাকিরা যারা শ্রমিকদের নিয়ে কথা বলতে চান তাদের ক্ষেত্রে কারখানায় ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ নেওয়ার খবর পাওয়া মাত্র শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়,ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়।
ইউনিয়ন থাকলে কী ধরনের সুবিধা শ্রমিকরা পান,আর কী ধরনের সুবিধা মালিকরা পান এমন প্রশ্নের জবাবে তৌহিদুল বলেন, যদি ইউনিয়ন থাকে তাহলে শ্রমিকরা তাদের অধিকারগুলো নিয়ে কথা বলতে পারেন দ্বিপক্ষীয়ভাবে। তৃতীয় পক্ষের দরকার হয় না। আর ইউনিয়নে যেহেতু শ্রমিকের বাইরে এক চতুর্থাংশ বাইরের পেশাজীবীরা থাকতে পারেন, তাই বুর্জোয়া মালিকরা সব সময় ইউনিয়ন অ্যাভয়েড করতে চান। তারা কেবল এমন শ্রমিককে রাখতে চান যারা চাকরির ভয়ে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যাবেন না।
মালিক আর শ্রমিকের ইউনিয়ন করা নিয়ে লুকোচুরির বন্ধে করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও সরকারের ধারাবাহিক ডায়ালগের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এটা একদিনের বিষয় না। একদিনের আলোচনায় আমরা ভাল ভাল কথা বলতে জানি এবং সেসবের কিছুই মানি না। এর জন্য সরকারের শক্ত মনিটরিং দরকার।
আরও পড়ুন-
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ বা বিলসের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশে পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার সব সময়ই ছিল, এটি কখনও নিষিদ্ধ ছিল না। একই সঙ্গে মালিকরা কখনও চায়নি এই খাতে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠুক।
গার্মেন্ট শ্রমিক নেত্রী মোশরেফা মিশু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কারখানাগুলোয় ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে তাজরিন গার্মেন্ট বা সাভারের রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা ঘটত না। কারণ কারখানার অনিরাপদ পরিবেশের বিষয়টি ইউনিয়ন তুলে ধরতে পারত। কিন্তু মালিক যে শ্রমিকের কাজের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ছে তাদের শত্রুই জ্ঞান করে। তাদের অধিকারের প্রশ্নে তারা কখনও ইতিবাচক ভাবে ভাবতে জানেন না।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যদি কারখানায় ইউনিয়ন হয় এবং সেটি যদি আইন কানুন মেনে চলে তা হলে মালিক শ্রমিক ভাল সম্পর্ক হতে পারে। কিন্তু তারা যে অভিযোগগুলো করে এবং মালিক পক্ষ থেকে ইউনিয়ন হলে ইউনিট বন্ধের যে প্রচারণা করা হয়ে থাকে সেটা একেবারেই ঠিক না। তিনি আরও বলেন, ইউনিয়ন কখনও বাইরে থেকে কেউ এসে করে দিতে পারবে না। কারণ তিনি শ্রমিকের এবং এই ইণ্ডাস্ট্রির কষ্ট বুঝবেন না।
/এমএসএম /আপ- এপিএইচ/