শুধু আজই আমগো কতা মনে পড়ে আপনাগো!

মে দিবসে কাজ করছেন রেনু বেগমরইদে (রৌদ্রে) পুড়ি, বিস্টিতে (বৃষ্টি) ভিজি, তহন কেউ খবর(খোঁজ) লয় না, আর আইজ কতো মানুষ আইছে ছবি তুলতে! ক্যান…খালি আইজকার দিনেই আমাগো কতা মনে পড়ে আপনাগো? মজা করেন সবাই আমগো লগে, সারাবছর কাইজ করি, আইজও করতাছি, না করলে খাইমু কি! কোনওদিন বাকি নাই, ইট ভাইঙ্গাই আমরা পেটে ভাত দেই, কথাগুলো নিজের মনের মতো করে বলছিলেন রেনু বেগম আর ইট ভাঙছিলেন।
এ দেশের নাগরিকই তো আমরা, এই দেশের ভোটারই তো আমরা, কই? কোনও সরকারই তো আমাগো ঠিক মতো দেখলো না… মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে বলেই চলেছেন তিনি। নিজের ঘর-বাড়িতে থাকমু, হাঁস-মুরগি পালুম, তা না, এই বয়সে রাস্তায় কাগজ টানাইয়া থাকি।
মেয়ে আর দুই নাতিন নিয়ে ঢাকার খিলগাঁয়ের মাটির মসজিদের পাশে থাকেন রেনু বেগম, ইট ভাঙার কাজ করেন। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কাজে আসছেন ৯টায় আর যাবেন ১টায়।
বরিশালের মঠবাড়িয়ার মেয়ে রেনু বেগম ঢাকায় এসেছেন বহুদিন হলো। স্বাধীনতা পর পরই তিন বছর বয়সে মার সঙ্গে ঢাকায় আসেন দুমুঠো ভাতের আশায়। গ্রামের বাড়িতে তখন খাওয়ার কষ্ট, বাপ ছোডো থুইয়া মরছে। গেরামের মানুষ কইছে ঢাকা যাও, পোলাপান নিয়া খাইতে পারবা। কিন্তু গরিবের কপাল বদলায় না, বরিশাল থেইক্যা ঢাকায় আইসা সেই কষ্টই করতে হইলো, এহনো করতাছি- বললেন তিনি।
আজ ১ মে মহান মে দিবস। অধিকার আদায়ে শ্রমিকদের আত্মত্যাগের স্মরণে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২য় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে দিনটিকে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এই দিনে বুকের রক্তে শ্রমিকরা আদায় করেছিলেন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়েই সেদিন মালিকরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে- শ্রমিকরাও মানুষ। তারা যন্ত্র নয়, তাদেরও বিশ্রাম ও বিনোদনের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেলো বিভিন্ন শ্রমিক আজও কাজে বেড়িয়েছেন। তাদের বক্তব্য হলো- কাজ না করলে পেটে ভাত জুটবে না।

মে দিবস কী জানতে চাইলে তারা বলেন, জানি না, কিন্তু পোলাপানে কইলো আইজ নাকি বন্ধ। কিন্তু কাজ না করলে তো খাইতে পারুম না।

মে দিবসে শুক্কুরী বেগমের কাজের সঙ্গী সন্তান

একই জায়গায় ইট ভাঙেন পাঁচ সন্তানের মা শুক্কুরী বেগম। গত কদিন ধরেই শরীরটা ভালো না থাকায় কাজ করতে পারছিলেন না। কিন্তু এভাবে ঘরে পরে থাকলে চুলা জ্বলবে না, পেটে খাওয়া জুটবে না সন্তানদের, তাই আজকের দিনে সকাল বেলাইতেই উপস্থিত হয়েছেন এখানে। জানালেন- ১০ টাকা ও ১৫ টাকার ইটের বস্তা রয়েছে এখানে। প্রথম দিকে খুব কষ্ট হলেও এখন আর হয় না, খুব দ্রুতও কাজ করতে পারেন। দিনে ১০ থেকে ১৫ বস্তা শেষ করতে পারেন তিনি। মে দিবসের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দিনটার কথা শুনছি, আইজ নাকি আমরা কাজ করমু না! কিন্তু কাজ না করলে খামু কী সেই কথা কেউ কয় না… বলেই নিজের মনে হাতের কাজের দিকে নজর দিলেন। কিছুটা যেন বুঝিয়ে দেওয়া- কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নেই।

মে দিবসে মীরবাগে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে

অপরদিকে ইট ভাঙতে গিয়েই হাত ভেঙেছেন মাদারীপুরের নুরজাহান বেগম। বয়সও হয়েছে, ঢাকাতেই থাকেন ২৫ বছর। এখন হাতের জোরটাও কমে গেছে। কোনওরকমেও দিনে তিন থেকে চার বস্তা ইট ভাঙেন তিনি। তাই দিয়ে চলে তার একার সংসার। ঘরে আজ খাওয়া নেই, তাই সকাল বেলাতেই নগদ টাকার আশায় এসেছেন ইট ভাঙতে। বিকেলে কাজ শেষে টাকা নিয়ে চাল আর সবজি কিনে ফিরবেন বাড়িতে। তারপরে খাওয়া জুটবে, তার ভাষায়- এই শইল্যে আর পেট খালি সহ্য হয় না, তাই চলে আইছি ইট ভাঙতে। সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করবেন বলে জানালেন নূরজাহান বেগম।

মে দিবসে মীরবাগে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে

অপরদিকে, মীরবাগের এক গলিতে গিয়ে দেখা গেলো- একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। সেখানে কাজ চলছে, তবে ধীর গতিতে। নির্মাণ কাজের দায়িত্বের তদারকিতে থাকা ফোরম্যান মিন্টু জানালেন, আমাদের আট জায়গায় এখন কাজ চলছে, মেইন রোডের পাশের সব কাজ বন্ধ, এইটা একটু ভেতরে, অনেক বিল্ডিংয়ের আড়ালে তো, তাই কাজ করছি। অপরদিকে, মালিক পক্ষের প্রেসারও আছে একটু, ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করতে হবে। তাই কাজ করাচ্ছি আজ ।

মিন্টু জানালেন, আজ কাজ করার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কাজ করতে হয় চাপের মুখে।

প্রতিদিনের মতো সকাল আটটা থেকে এখানে কাজ শুরু করেছেন আব্দুল করিম ও হযরত, করবেন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত।

আজ কি দিবস আপনারা কি জানেন? প্রশ্ন করলে আব্দুল করিম বলেন, জানি আজ মে দিবস। কিন্তু জাইনা লাভ কি! কাম কইরাই খাওন লাগবো। গরিব মানুষের অনেক জ্বালা, কোনও দিবস সেই জ্বালা মিটাইতে পারে না।

/এএইচ/