মমতার শপথের আগে তিস্তা নিয়ে নতুন আশা

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের  দ্বিতীয় মেয়াদে শপথ গ্রহণের আগ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার আলো দেখা গেল। মমতার বিদায়ী সরকারের যিনি সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই তৃণমূল নেতা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘আগে যা হয়েছে, হয়েছে। এখন নতুন সরকার বিষয়টাকে আবার নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেই পারে। যদিও পুরোটাই মুখ্যমন্ত্রীর এখতিয়ারে!’
সেচমন্ত্রী হিসেবে রাজীবই গত পাঁচ বছর পশ্চিমবঙ্গে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিস্তা চুক্তির জটিলতা এবং এর নানা খুঁটিনাটি তার হাতের তালুর মতোই চেনা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত আস্থাভাজন এই নেতা পশ্চিমবঙ্গের সদ্যসমাপ্ত ভোটে গোটা রাজ্যের মধ্যে সব চেয়ে বেশি ব্যবধানে জিতে রেকর্ড গড়েছেন। নতুন মন্ত্রিসভাতেও তিনি সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সেই রাজীব যখন তিস্তা নিয়ে নতুন সম্ভাবনার কথা বলছেন, তখন সেটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না কিছুতেই।
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘আমরা তিস্তা চুক্তির শুধু বিরোধিতা করে গেছি, ব্যাপারটা সে রকম নয়। আমাদের সরকারের বক্তব্য ছিল খুব সহজ, পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থবিরোধী কিছু করা যাবে না। তিস্তা নিয়ে রাজ্যের স্বার্থকে নিশ্চয় আমরা জলাঞ্জলি দেব না, তবে এখন নতুন সরকার আসছে, নতুন সরকার হয়তো বিষয়টাকে আবার নতুন আঙ্গিকে দেখতেই পারে। একটু অপেক্ষা করুন, তাহলেই সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।’
ঘটনা হলো, দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারাও ইঙ্গিত পাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার জট খুলতে উদ্যোগী হবেন। এর প্রথম আভাস মিলেছিল যখন ভোটের ফল প্রকাশের দিনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় নিজের বাসভবনে ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া প্রতিবেশী দেশগুলোর (অর্থাৎ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান) সঙ্গে ‘সম্পর্ক আরও বন্ধুত্বপূর্ণ’ করে তুলতে চান।

মমতা শুধু মুখেই বলেননি, তিনি শুক্রবার তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। জাপান সফর আগে থেকে নির্ধারিত থাকায় শেখ হাসিনা কলকাতায় সেদিন যেতে  পারছেন না ঠিকই, কিন্তু তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যতের জন্য এটাকে বেশ ইতিবাচক ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য হাসিনা তার যে ক্যাবিনেট মন্ত্রীকেই পাঠান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খুব সম্ভবত তাকে একেবারে হতাশ হয়ে ফিরতে দেবেন না।

আসলে কেন্দ্রও মনে করছে তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত না হওয়ায় পাশের দেশ বাংলাদেশে যে তাকেই মূলত দায়ী করা হয়, এটাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিলক্ষণ জানা। এতদিন আঞ্চলিক রাজনীতির গণ্ডিতে আটকে থাকায় সেটা নিয়ে তার মাথা না-ঘামালেও চলত। কিন্তু এখন পরপর দুবার বিপুল ভোটে জিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জাতীয় রাজনীতিতেও ধীরে ধীরে পা রাখতে চাইবেন, সেটা খুব স্বাভাবিক। সে কারণেই আঞ্চলিক স্বার্থের পাশাপাশি তাকে জাতীয় স্বার্থের দিকেও তাকাতে হবে, যেটা তিস্তা চুক্তির জন্য অবশ্যই সুখবর।

এদিকে, তিস্তার পানি ভাগাভাগির সম্ভাব্য সমাধান-সূত্র বার করার জন্য বছর পাঁচেক আগে মমতা যে নদী বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই ড. কল্যাণ রুদ্রও কিন্তু বিশ্বাস করেন তিস্তা চুক্তি না হওয়ার কোনও কারণ নেই। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তার কমিশন রিপোর্ট জমা দিয়ে দিয়েছে অনেক আগে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার একটা ‘অলিখিত চুক্তি’ থাকায় আজ অবধি ড. রুদ্র তার রিপোর্টের বিষয়বস্তু নিয়ে কখনও সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলেননি।

তবে বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে সম্প্রতি ড. রুদ্রও তার ঘনিষ্ঠ মহলে মন্তব্য করেছেন যে, তার রিপোর্টে ‘বাংলাদেশবিরোধী’ কোনও সুপারিশ নেই। ফলে এতদিন চুক্তি না হওয়ার জন্য তার রিপোর্টকে ঢাল করাটাও ড. রুদ্র ঠিক মেনে নিতে পারেন না।

তিনি বরং ঘনিষ্ঠ মহলে এটাই বলেছেন, ‘আমি একজন বিজ্ঞানী, আমি নদীকে ভালোবাসি। বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে এই নদীকে রক্ষা করে কিভাবে ভাগাভাগির সূত্র বের করা যায় আমি শুধু সেটাই বলেছি। তবে আমি এটাও বুঝি যে, বিজ্ঞানীর দৃষ্টি আর রাজনীতিবিদের দৃষ্টি সব সময় এক হয় না!’

কিন্তু এতদিন বাদে জনতার বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হয়তো তিস্তা চুক্তির জটিলতাকে নতুন দৃষ্টিতে দেখবেন, সেই সম্ভাবনা ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। 

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনা বৈঠক করবেন ক্যামেরন-আবের সঙ্গে

/এমএনএইচ/