সব ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানে ‘ব্যর্থ’ ইসি

নির্বাচন কমিশনদেশের বিদ্যমান সব ধরনের নির্বাচন পরিচালনায় বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করছেন রানজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ইসি তার সাড়ে ৪ বছরের মেয়াদে সব ধরনের নির্বাচন পরিচালনা করলেও কোনও নির্বাচনকেই কমিশন বিতর্কের বাইরে রাখতে পারেনি। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের মাপকাটিতে প্রতিটি নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচন ইসিকে বিতর্কের মধ্যে ফেলেছে বলে বিশ্লেষকরা অভিমত দিয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সার্চ কমিটি গঠন ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের নিয়োগ দেন। বিদায়ী এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের উত্তারাধিকারী কাজী রকিবউদ্দীনের আহমদের নেতৃত্বাধীন এই কমিশন ২০১২ সালে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে দায়িত্বভার নেয়। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কমিশন নিয়োগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে গেলেও নিয়োপের পরপরই এর বিরোধিতা করে। এদিকে দায়িত্ব পেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিব বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন একটি মৌলিক অধিকার। এই অধিকার রক্ষায় আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাব।
বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নতুন নির্বাচন কমিশনের বিরোধিতাকে কৌশল হিসেবে মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এ সময় তিনি কাজের মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল ও জনগণের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবেন বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিরোধী দলকে আস্থায় নেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আস্থার প্রতীক হয়ে অবাধ নির্বাচনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করব। তবে, গত সাড়ে ৪ বছরে কমিশন বিএনপি ও তার সমমনা রাজনৈতিক দলকে সেই অর্থে আস্থায় আনতে পারেনি। তাদের পাশাপাশি বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও নতুন করে কমিশনের সমালোচনা করতে শুরু করেছে।

বর্তমান কমিশন ২০১২ সালে দায়িত্ব নেওয়া পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত দেশের প্রচলিত জাতীয় সংসদ, সংসদের উপ-নির্বাচন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ ও সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা করেন। এর মধ্যে কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছাড়া অন্য সব নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রতিবারই নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয়েছে ইসি।
নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই বছর ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বচন অনুষ্ঠান করে। ওই নির্বাচন নিয়ে কিছুটা বিতর্ক হলেও ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত ৫ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে কমিশনের ভাবমূর্তি খানিকটা উজ্জ্বল হয়। একযোগে অনুষ্ঠিত খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও এর অব্যবহিত পরে অনুষ্ঠিত নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কমিশন ভূয়ষীয় প্রশংসা পায়। দেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের ফল বিনাবাক্যে মেনে নেয়।
কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী সময়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে ছন্দপতন হয়। দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনটি তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিতর্কে জড়াতে থাকে কমিশন। নির্বাচনের আগে বিনাভোটে ১৫৩ জন বিজয়ী, মনোনয়নপত্র জমা ও প্রত্যাহারে অনিয়ম, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার না করলেও অনেকের পেছনের তারিখে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারসহ নানা অনিয়রে অভিযোগ ওঠে সেই সময়। নির্বাচনের সময়ও পাওয়া যায় ব্যাপক কারচুপি ও জোর জবরদস্তির খবর। জাতীয় নির্বাচনের অব্যবহতি পরে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানেও ব্যর্থতার পরিচয় দেয় কমিশন। পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনের প্রথম দুই ধাপ কিছুটা ভালো হলেও শেষ ধাপগুলোতে অবাধ ও নিরপেক্ষতার প্রশ্নে ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এরপর ২০১৫ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ‍ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও কেন্দ্র দখল, জাল ভোট, সহিংসতাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগে ওই নির্বাচনে অংশ নেওয়া দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সমর্থিত তিনজন মেয়রপ্রার্থীই নির্বাচন বয়কট করে। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত ২৩৪টি পৌরসভা ও চলতি বছর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত ৪ হাজারের বেশি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হয় কমিশন। বিশেষ করে সদ্য অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই নির্বাচনের ইতিহাসের সব থেকে খারাপ নির্বাচন বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সদ্য শেষ হওয়া ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে কারচুপি ও ব্যাপক হতাহতের ঘটনার পর বিএনপি ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা এই ইসির অধীনে আর কোনও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে যাবে না। বর্তমান কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান ইসি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্বে রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব) সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন সফল না ব্যর্থ হয়েছে, তা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে। দেশের জনগণ বলে দেবে ইসি কতটুকু ভালো বা মন্দ নির্বাচন করেছে। বিগত কমিশনের সঙ্গে তুলনা করলেই জনগণ বিষয়টি মূল্যায়ন করতে পারবে। তবে, এই কমিশন ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন ও পরবর্তীতে যে নির্বাচনগুলো করেছে সেটাকে নির্বাচনের কোনও সংজ্ঞায় ফেলানো যাবে না। সাংবিধানিক সংস্থা হিসেবে নির্বাচন কমিশনের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে বর্তমান কমিশন তা ‍সঠিকভাবে পালন করতে পারেনি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
নির্বাচন কমিশন হিসেবে তাদেরও বর্তমান সরকারের অধীনে কাজ করার অধিকার রয়েছে উল্লেখ করে সাবেক এই কমিশনার বলেন, এই কমিশনকে শুরু থেকেই সামর্থ্যহীন মনে হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য তাদের কোনও চেষ্টা ছিল বলে মনে হয় না।
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ‍বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছাড়া প্রশংসা করার মতো কোনও নির্বাচন বর্তমান কমিশন জাতিতে উপহার দিতে পারেনি। স্বাধীন সত্তা হিসেবে এই কমিশন শুরু থেকেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
সদ্য সমাপ্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের নামে আমরা যেটা এবার দেখলাম সেটাকে নির্বাচন না বলে অন্য কিছু বলতে হবে। আর আমি মনে করি, এর দায়ভার কমিশন কোনওভাবে এড়াতে পারে না। নির্বাচনের সময় কমিশনের হাতে অনেক ক্ষমতা দেওয়া থাকে। কিন্তু এই কমিশন তা প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে।
অবশ্য নিজেদের ব্যর্থ বলতে রাজি নন নির্বাচন কমিশনার মো. ‍শাহ নেওয়াজ। বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যত নির্বাচন হয়েছে, তার কোনওটাতেই তারা আইনের ব্যত্যয় ঘটাননি। কোনও নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। তবে, সংশ্লিষ্টদের থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পাওয়ায় কিছু কিছু নির্বাচনে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এর জন্য সার্বিকভাবে কমিশনকে দায়ী করা বা ব্যর্থ বলার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন: ‘ঢামেকের যে লিফটের দরোজা-জানালা কিছুই নেই’

/এমএনএইচ/আপ-এমও/