মাইশা জানে না, বাবা নেই

মা-বাবা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মাইশামাইশা হাসপাতালে আসার পথেও কথা বলেছে, মাঝে দুইদিন একটু চুপ ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার রাত থেকে আবার একটু একটু করে কথা বলা শুরু করেছে। এদিন রাতে ভাত খেতে চেয়েছে, চিকিৎসকদের অনুমতি নিয়ে তাকে ভাত খাইয়েছি। আবার আজ বুধবার সকালে মাংস খেতে চেয়েছিল। চিকিৎসকরা অনুমতি দেওয়ায় আজ দুপুরে সে মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছে। কিন্তু একটু পরপরই জানতে চায়, সবাইকে দেখছি, বাবাকে দেখছি না, বাবা কোথায়? তখন আমরা অন্যকিছু বলে কাটিয়ে দেই। মাইশা এখনও জানে না, তার বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন।এই ধাক্কা সে সইতে পারবে না।
মাইশার আত্মীয় সুলতান বাদশা এভাবেই অবস্থার বর্ণনা দিলেন বুধবার।
চিকিৎসকরা বলছেন, মাইশা এবং তার ভাইয়ের শারীরিক অবস্থা একটু ভালো হলেও এখনও বলার মতো উন্নতি নেই। কারণ পোড়া রোগীর ক্ষেত্রে ১৪ দিনের আগে কিছুই বলা সম্ভব নয়।
এগারো বছরের মাইশা এখন রয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে। পাশে রয়েছে নয় মাসের ভাই মুনতাকিন। আর এইচডিইউয়ের (হাই ডেফিসিয়েন্সি ইউনিট) বাইরে সন্তানের সুস্থতা কামনায় রয়েছেন মাসহ স্বজনেরা।
মাইশার দাদা সুলতান রব বলেন, আমরা ওখানে আসা যাওয়া করছি, কিন্তু ওদের মা সেই যে হাসপাতালে ওদের নিয়ে এসেছে, তারপর থেকে ওখানেই ঠায় বসে আছে। ওকে ওখান থেকে নড়ানো যায়নি। দুইহাত তুলে দিনরাত সৃষ্টিকর্তার কাছে দুই সন্তানের প্রাণভিক্ষা চাচ্ছে।
গত ২৪ জুন উত্তরার আলাউদ্দিন টাওয়ারের লিফট ছিঁড়ে আগুনের সূত্রপাত হলে সেই আগুনে দগ্ধ হন প্রকৌশলী মাহমুদ হাসান রিপন ও তার দুই সন্তান মেহনাজ হাসান মাইশা ও নয় মাসের শিশুপুত্র মুনতাকিন হাসান।

সেদিনই তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। পরদিন ভোরে ৮৮ শতাংশ বার্ন হওয়া মাহমুদ মারা যান। আর দুই সন্তান এখনও চিকিৎসা নিচ্ছে বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শ্বাসনালীসহ মাইশার শরীরের প্রায় ৫৫ শতাংশ আর মুনতাকিনের শরীরের প্রায় ২৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। কোনও শিশুর যদি ১০ শতাংশ পুড়ে যায় তাহলেই তাকে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করি, বললেন চিকিৎসক।

গত ২৫ জুন সকালেই এই দুই শিশুর চিকিৎসায় বার্ন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালামকে প্রধান করে ডা. সামন্ত লাল সেন, অধ্যাপক ডা. মো সাজ্জাদ খোন্দকার, অধ্যাপক ডা. রায়হানা আউয়াল, নেফ্রোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, শিশু বিভাগের অধ্যাপক ইফফাত আরা সামশাদ, মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ আহম্মেদ এবং বার্ন ইউনিটের অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহ আলম ভূঞাকে নিয়ে গঠিত হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ড।

গতকাল (মঙ্গলবার) স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বার্ন ইউনিটে যান অগ্নিদগ্ধ এই দুই শিশুকে দেখতে। সেখানে তিনি তাদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন। চিকিৎসকদের বলেন, দরকার হলে সরকার তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।

বার্ন ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত দুইদিনে অনেক ইমপ্রুভ করেছে ওরা, আমরা এতে সন্তুষ্ট। কিন্তু মাইশার দুই পা, দুই হাত, শ্বাসনালীসহ মুখ, শরীরের ৫৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। ওর অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক ছিল। কিন্তু গত শনিবারে মাইশার দুই হাতের একটা অপারেশন করা হয়েছে আঙুলগুলো বাঁচানোর জন্য, আজ দেখলাম অনেক উন্নতি হয়েছে। আশা করছি হাত দু’টি বাঁচাতে পারবো।

দুই একটি আঙুল হয়তো ঠিক হবে। তবে এতো পুড়ে যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রে আসলে ১৪ দিনের আগে কিছুই বলা যায় না। মেয়েটা খুব বেশি পুড়েছে, বলেন তানভীর আহমেদ।

মাইশার আগে থেকেই শারীরিক কিছু সমস্যা ছিল জানিয়ে তানভীর আহমেদ বলেন, মাইশার মায়ের কাছে শুনেছি তার ইউরিন ইনফেকশনজনিত সমস্যা ছিল, আর তার ওয়েট অনেক বেশি যেটা এই বয়সে হওয়ার কথা না। তার এই ওজনটাও আমাদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে দুই ভাই-বোনই মুখে খাবার খাচ্ছে যেটা আমাদের সন্তুষ্টির আরেক কারণ, বললেন এই চিকিৎসক। তবে দুইজনের অবস্থাই ক্রিটিক্যাল, আমরা আপাতত সন্তুষ্ট হলেও এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না। যে কোনও সময় অবস্থার অবনতি ঘটতে পারে, আশা করছি সেটা যেন না হয়, বলেন ডা. তানভীর।



/জেএ/এমএসএম/এজে