‘কিছুই ঘটেনি এমন বার্তাই দিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালি জাতির ইতিহাসে জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার প্রথম বেতার ভাষণে এ বিষয়ে ‘টু’ শব্দটি করেননি। মনে হয়েছিল আসলে কিছুই ঘটেনি, সব স্বাভাবিক আছে।

মোশতাক আহমেদের প্রথম বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায় দৈনিক বাংলা পত্রিকায়। যেখানে তিনি দাবি করেছিলেন, “জাতির সামনে ‘অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছেন’। ‘আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত’ সংগ্রামে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি, সর্বপ্রকার কলুষ থেকে দেশকে রক্ষা করার সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা।”

১৫ আগস্টের কালোরাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে খুনিরা মেতে উঠেছিল হত্যার উল্লাসে, যেকোনওভাবে ক্ষমতাদখলই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করছেন গবেষকরা। ওই রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, ছেলে, পুত্রবধূ, ভাই, ভাগ্নে, ভাগ্নের স্ত্রীসহ ১৭ জনকে হত্যা করা হয়।

মোশতাকের অবস্থানকে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারী উল্লেখ করে হত্যাকাণ্ডের তদন্তকারীরা বলছেন, ‘তাকে (মোশতাক) এই মামলায় বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি ঠিকই। কিন্তু মাস্টারমাইন্ডের তালিকায় তার নাম ছিল।  এক জঘন্য খেলার অংশীদার ছিলেন তিনি।’

তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোশাররফ হোসেন খান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকারও তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। পরের দিনের পত্রিকায় ‘সবকিছু নিয়ন্ত্রণে’, ‘সব কাজ শুরু হচ্ছে’ এধরনের বক্তব্য ভরে ওঠে পত্রিকার পাতা।

ইতিহাসবিদরা মনে করেন, তিন বাহিনীর তিন প্রধানের এই ঘোষণার পর ‘বিদ্রোহ’ দমনের সামান্য সম্ভাবনাটুকুও নিভে যায়। তার ওপর রাষ্ট্রপতির ভার অর্পণের বিষয়ে মোশতাক বলেন, ‘প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা, এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপদানের পুত পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলা ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার ওপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়েছে।’

তার এই বক্তব্যকে চালাকি অ্যাখ্যা দিয়ে ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেন, এ ধরনের মিথ্যাচার ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে করা সম্ভব। তার ওপর কে দায়িত্ব দিয়েছে এবং কী প্রক্রিয়ায় সেটার সাক্ষী ইতিহাস। কিছুই ঘটেনি এমন বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক।

প্রথম ভাষণেই স্পষ্ট হয়ে যায় বাংলাদেশ কোন পথে পরিচালিত হবে। ‘বর্ণবাদ, বর্ণ বৈষম্যবাদ, উপনিবেশবাদবিরোধী আমাদের নীতি অব্যাহত থাকবে। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ ও জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সস্পর্ক অটুট রাখার ঘোষণা দেন মুশতাক। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করতে ভাষণে বলা হয়, ‘দেশের শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী তা সম্ভব না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্রবাহিনী পরমতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশবাসীর সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করেছে।’

মামলাটির তদন্তের সমন্বয়কারী আব্দুল হান্নান বলেন, ‘আমরা অনেকের নামই হাজির করেছিলাম। কিন্তু আদালত হত্যায় জড়িত সেনাসদস্যদের বিষয়ে মনোযোগ দিয়েছিল।’ খন্দকার মোশতাকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের স্থানে তিনি উপস্থিত না থাকলেও এই হত্যা এবং হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী বিষয়াদির সুবিধা সবটাই তিনি নিয়েছেন এবং এর একটি অংশ হিসেবে তার দায় আছে।

/এসটি/টিএন/

ছবি: আইসিএসএফ