ঢাকার রাস্তায় নারী: ‘রোজ ভাঙে আত্মবিশ্বাস’





ঢাকার রাস্তায় নারী, ছবি- অ্যাকশন-এইডঅফিস থেকে বের হই সকাল সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। অভিজাত এলাকায় অফিস। ফেরার সময় অফিসের গাড়িতে যাই বা নিজের ব্যবস্থায় বাসে সিএনজি অটোরিকশায় যেভাবেই যাই, নিজের প্রতি কোনও কনফিডেন্স পাই না। এই না পাওয়ার কারণ আমাদের আশেপাশে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা। কিন্তু এই নিরাপত্তাহীনতা বোধ নিয়ে নারী আদৌ কতদূর এগিয়ে যেতে পারবে প্রশ্ন হাজির করেন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত শাবনাজ। তিনি বলেন, ‘আমি অফিসের গাড়িতে গেলে পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিন্তে থাকেন। কিন্তু এই গাড়িও ততক্ষণ নিরাপদ না, যতক্ষণ আমার নিজের মধ্যে নিরাপত্তার বোধ তৈরি না হচ্ছে!’

‘আমার বাসা থেকে কলেজ বেশ খানিকটা দূর। বাসে করে যাই। রোজ অস্বস্তি নিয়ে বাস থেকে উঠি, নামি। হেলপার শরীরের নানা জায়গায় হাত দেয় যেন সে নামতে-উঠতে সহায়তা করছে। কিন্তু বাস ঠিকমতো স্ট্যাণ্ডে থামলে মেয়েরা দিব্যি ওঠানামা করতে পারে; গায়ে হাত দেওয়ার ছুঁতা কেউ পাবে না।’ কথাগুলো বলছিলেন ধানমণ্ডির একটি নামকরা কলেজের ছাত্রী উম্মে হাবিবা। তিনি বলেন, ‘আমার থেকে কমবয়সী একজন ছেলে সেদিন বাসের দরজায় হেলপারগিরি করছিল। আমি দেখলাম, সে ইচ্ছে করে চালককে নির্দিষ্টস্থানে থামাতে বললো না। চলন্ত গাড়ি একটু ধীরগতি করে আমাকে নামানোর সময় পুরো পিঠে হাত দিয়ে কটুক্তি করে বাস টান দিলো। এধরনের ঘটনা ঘৃণা তৈরি করে রোজ। রোজ নিজের ভেতরের আত্মবিশ্বাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়।'
যৌন হয়রানি বা নির্যাতন কোনও বিশেষ বয়সের নারীর ক্ষেত্রেই ঘটেনা; কিশোরী বা প্রাপ্তবয়স্ক সব বয়সের নারীর ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে পারে। যদিও বয়সভেদে নারী নির্যাতন বা হয়রানিতে ভোগার এ হার কিছুটা কমবেশি হয়।
বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড-এর ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয় নারী’ প্রচারণার অংশ হিসেবে করা এক গবেষণা তথ্য মতে, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস ২০১৪ সালের মে-জুন মাসে নারায়ণগঞ্জসহ দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে ১২০০ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এর মধ্যে ৮০০ জন নারী ও কিশোরী এবং বাকি ৪০০ জনের মধ্যে ২০০ জন পুরুষ এবং ২০০ জন হলো অনুর্ধ্ব ১৮ বছরের ছেলে।

কেবল কিশোর বয়সীরা হয়রানির শিকার হয় বলে যে ধারণা আছে, তা ভুল প্রমাণিত হয় অ্যাকশন-এইড-এর পরিচালনায় করা এক গবেষণার ফলাফল থেকে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, অনুর্ধ্ব ২০ বছরের নারী/কিশোরীদের শতকরা ৭৬ ভাগ যৌন হয়রানির মতো নির্যাতনের শিকার হন। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই হয়রানি কমছে মনে হলেও ত্রিশোর্ধ্ব বয়সী নারীদের মধ্যে এই হার ৪৪ শতাংশ।
শিক্ষা ও কর্মস্থলে যাওয়াসহ নানাবিধ কাজে রাজধানী ঢাকার পথে বের হওয়া নারীদের অধিকাংশই চলতিপথে নানা যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু আত্মবিশ্বাস ভাঙতে থাকার কারণে তারা মুখ খোলেন না বলে মনে করেন নারী নেত্রীরা। তারা বলছেন, হয়রানি বা নির্যাতন চরম পর্যায়ে না পৌঁছালে নির্যাতিত নারী অভিযোগ উত্থাপন করেন না।

`She Can`, ছবি- অ্যাকশন-এইড
বর্তমান সমীক্ষা অনুযায়ী, শতকরা ৫০ ভাগ নারীই মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোনোরকম প্রতিবাদ করেননি। নীরবে নির্যাতন সহ্য করার সংস্কৃতি এত প্রবল যে অ্যাকশন-এইড-এর গবেষণা বলছে, মাত্র ৫৪ শতাংশ নারী নির্যাতনের ব্যাপারে পরিবারকে অবহিত করেছেন। বাকি ৪৬ শতাংশ নারীই এসব বিষয়ে পরিবারকে জানাননি।তবে এখন পর্যন্ত আশার কথা হলো, শতকরা ৪১ ভাগ নারী তাৎক্ষণিকভাবে হয়রানির প্রতিবাদ করেন অথবা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেহেতু নারী ঘরের বাইরে তার অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়, সেহেতু সে “ঝামেলা এড়ানোর” উদ্দেশ্যে হয়রানির কথাগুলো অভিযোগ আকারে তুলতে চান না। তবে একেবারেই চুপ করে থাকেন, তা কিন্তু নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ যেটা করেন, সেটাও আগে ছিল না। এখন ধীরে ধীরে হচ্ছে; এটা ইতিবাচক। কিন্তু ঘটনাগুলোর হার কমাতে হলে এগুলো অভিযোগ আকারে আনতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানা কারণে নারীরা সরব হতে চান না। প্রথমত, পরবর্তীতে সমস্যা বাড়তে পারে এই ভয়ে এবং দ্বিতীয়ত ভুক্তভোগীরা ভাবেন, একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে কী হবে! আশেপাশে এরকম একশ জন আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়,পাল্টা রুখে দেওয়ার পথগুলো নিয়ে কিছু বের করা জরুরি।’ অনলাইনে নানা প্রতিবাদ ও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোর কথা উল্লেখ করে জোবাইদা নাসরিন আরও বলেন, ‘সম্প্রতি রিকশাপেইন্টের মাধ্যমে প্রতিবাদ, মোবাইলের কাভারে নানা প্রতিবাদ স্লোগান লিখে রাখার মতো প্রতিবাদগুলো বেশ কার্যকর বলে আমার মনে হয়েছে। নারীদের বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা এবং নিজেদের মতো করে একাট্টা হয়ে সমাধান বের করাটা জরুরি।’
ইউআই /এবি/