গুমের শিকার ব্যক্তিদের ভারতে হস্তান্তর করা হতো বলে গুম সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারত থেকেও সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কাউকে কাউকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু ফিরিয়ে আনার পর দীর্ঘ দিন তাদের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) কার্যালয়ে আটকে রাখা হয়েছে।
গুম সংক্রান্ত ঘটনা তদন্তে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত কমিশন তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এ ধরনের ঘটনার পেছনে শুধু দেশীয় নিরাপত্তা বাহিনীই নয়, বরং বিদেশি অংশীদারদের ভূমিকা এবং বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বিধা ও মতবিরোধও রয়েছে। মতবিরোধের কারণে বাহিনীর অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৩ জুন) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে গুম সংক্রান্ত প্রাথমিক প্রতিবেদনের একটি অধ্যায় গণমাধ্যমের কাছে পাঠানো হয়। প্রতিবেদনের এই অংশে এসব বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
এলিট ফোর্স র্যাবের হাতে গুম হওয়া এক ব্যক্তি কমিশনের কাছে বর্ণনা করেছেন, তাকে এক জায়গায় তিন মাস আটকে রাখা হয়। পরে তাকে বলা হয়, তাকে দেশের বাইরে রাখা হবে। পরে একদিন তাকে রাতের আঁধারে সীমান্ত পার করিয়ে ভারতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
আরেক ভুক্তভোগী কমিশনকে বলেন, তাকে ইন্ডিয়াতে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে একদিন রাতে তার মুখে কালো কাপড় বেধে রাতের আঁধারে বাংলাদেশে আনা হয়। এরপর তিনি দীর্ঘ দিন ডিজিএফআই’র হেফাজতে গুম হয়েছিলেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপন বন্দিশালায় থাকা অবস্থায় ভুক্তভোগীদের সঙ্গে এমন ব্যক্তিরাও কথা বলেছেন, যারা হিন্দি ভাষায় কথা বলেন। এমনটি টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই) থাকা বন্দিদের বেলাতেও এরকম ঘটনা ঘটেছে।
কমিশন মনে করে, এই বিবরণগুলো বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক, অস্বচ্ছ এবং দ্বিপাক্ষিক গোয়েন্দা সহযোগিতার ধারাবাহিকতাকে ইঙ্গিত করে, যার মধ্যে সীমান্ত পারাপার এবং বন্দিদের যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপরের তথ্যগুলো থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, এই সহযোগিতা সবসময় যে কোনও ব্যতিক্রমধর্মী নিরাপত্তা হুমকির প্রতিক্রিয়ায় পরিচালিত হয়েছে তা না; অনেক ক্ষেত্রেই তা ছিল অবাক রকমের তুচ্ছ কারণ দ্বারা প্ররোচিত।
কমিশন বলেছে, গুম বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার ফল ছিল না, বরং এটি এমন একটি কাঠামোগত ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছিল, যেখানে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল-বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতার নামে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সম্পৃক্ততা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের একটি অংশ গুমসহ নানা বেআইনি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, গুম সংক্রান্ত বিষয়ে নিরপেক্ষ মত দেওয়ার কারণে তাকে সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, নতুন পদায়নের আগেই তার সম্পর্কে সতর্ক বার্তা ছড়ানো হতো, এমনকি তার পরিবারের ওপর নজরদারি চলতো।
এক যুবক কমিশনকে জানিয়েছেন, তার ভাই একটি গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করতেন। তাকে রাজনৈতিক ‘বিরোধীদের’ তালিকা করতে বলা হয়েছিল। পরে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি জানার পর ওই কর্মকর্তা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তার ভাই এবং শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
একজন সৈনিক গুম কমিশনকে জানিয়েছে, তাকে একটি গোপন বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছিল যেখানে বন্দিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো। এমনকি তাকেও নির্দেশনা দেওয়া হয় যেন স্বাভাবিক ব্যবহার না করা হয়, বরং বন্দিদের কষ্ট দেওয়ার নির্দেশ মেনে চলা হয়। বন্দিদের সামনে কথা বলাও নিরুৎসাহিত করা হতো।
কিন্তু ওই সৈনিক একপর্যায়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের ওপর নির্যাতন প্রতিরোধের ছোটখাটো চেষ্টা করতেন। কখনও কখনও নিজের খাবার বন্দিদের দিয়ে দিতেন। এক বন্দি কমিশনকে সরাসরি জানান, ওই সৈনিকের দেওয়া খাবারে তিনি বেঁচে ছিলেন।
র্যাবের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, তাকে একজন বন্দিকে হত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা অমান্য করেন এবং ৫ আগস্ট পর্যন্ত দায়িত্বে থেকে তার অবস্থান ধরে রাখেন।
কমিশনের ভাষ্য, ‘সবসময়ই যে অবাধ্যতার ফলাফল তাৎক্ষণিক হয়, তা নয়। কেউ কেউ তাদের অবস্থান জানানোর পরও টিকে ছিলেন।’ যেমন দুজন র্যাব সদস্য র্যাব গোয়েন্দা প্রধানকে নিজ হাতে লেখা চিঠিতে জানান যে তারা বেআইনি কোনও আদেশ পালন করবেন না।
এক চিঠিতে লেখা ছিল, ‘যদি কোনও অভিযান আইন বহির্ভূত বা আইন বহির্ভূত গুলি চালানোর উদ্দেশ্যে হয়, তাহলে আমি তাতে অংশ নিতে পারবো না।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত সরকারের পতনের আগে এই ধরনের কয়েকটি নোট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকেও পাঠানো হয়েছিল, যা পরে গণভবন থেকে উদ্ধার হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের ট্রেনলাইন কিংবা চলন্ত যানবাহনের নিচে ফেলে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে।’
প্রতিবেদন বলছে, ‘গুমের মতো অপরাধকে অনেকাংশে অঘোষিতভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল এবং যারা এসব করেছিল, তারা প্রকৃত অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হননি।’
কমিশনের প্রতিবেদন জানায়, আন্তর্জাতিক সংযোগও এই ঘটনার পেছনে কার্যকর ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছাড়াও, আওয়ামী লীগ সরকার সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পশ্চিমা সহযোগিতার সুবিধাও পেয়েছে।’ একজন ভুক্তভোগীর বরাত দিয়ে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই ভুক্তভোগীকে ডিবির হেফাজতে দুজন আমেরিকান নাগরিক জেরা করেছিলেন। যদিও তারা সরাসরি নির্যাতনে অংশ নেয়নি, কিন্তু তাদের উপস্থিতিই এই বেআইনি আটক ব্যবস্থাকে বৈধতা দিয়েছে।