কান্দন দেকপার আইসেন বাহে!

কড়াইল বস্তিতখনও আলো ফোটেনি। সাত সকালে রাজধানীর কড়াইল বস্তি এলাকায় ঢুকতেই থমকে যেতে হয়,পেছন থেকে আসা এক পুরুষের কণ্ঠে- কান্দন দেকপার আইসেন বাহে! ফিরে তাকিয়ে দেখি, সারা রাত ঘুমহীন আর অনবরত কান্নায় বুজে আসছে তার দুচোখ যেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে আস্তে করে জড়িয়ে ধরতেই বলেন, ‘থাকতে না দিলে না দেবে, আমাদের নিয়া খেলে ক্যান। সে উত্তরতো মাথাত কাইল থাইকা আসে না।’

তিনি বলেই চলেন,কিভাবে আগুনে নিজের ঘর পুড়তে দেখেছেন, কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। মাসের শুরুর বেতনটাও ঘরেই পুড়ে গেছে। নিজের ঘর নেই, এখনও পোড়া টিনের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি উল্টো আমাকেই বলেন, ‘কিসু মনে নিয়েন নারে মা, পানি খাও।’

বাড়ি কই রংপুর কিনা, জিজ্ঞেস করে হ্যা সূচক শব্দ শুনতে শুনতে তাকে নিয়েই সামনে এগোই। যারা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় রাতে যেতে পারেননি, তারা ছোট ছোট দলে তখনও আধাশোয়া। পাশে কেউ কেউ বসে ভাবছেন, এরপর কী করবেন।

কড়াইল বস্তিএরমধ্যেই আরেকটু কম বয়সী এক নারীর কণ্ঠ এগিয়ে আসতে থাকে। ততক্ষণে ভিড় বেড়েছে। এত মানুষের ভিড়, এত মানুষের হুল্লোরে বিরক্ত হয়ে সেই নারী বলেন,‘কাম করি বড়লোকদের।যোগাযোগও বড়লোকদের সঙ্গে। কিন্তু আমরা এট্টুন জায়গায় থাকলেই নাকি সমস্যা। মিলায়ে নিয়েন আপা। আবার এখানে ঘর উঠবে, উচ্ছেদ আসল কথা না।হেগোর ট্যাকা লেনদেনে কিসু এটা ঝামেলা হইসে। মিলায়ে নিয়েন।’

মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করি, ‘এটা আসলটা?’ তিনি বলেন, ‘হ। আসল হইলো, কারোর কারোর লাভ। আমাদের দেখায়ে লাভ, আমাদের পুড়ায়ে লাভ। বস্তি ঘরতো বড়লোকেরা আবারও তুলবো। কিন্তু আমার বালিশ-কাঁথা-কম্বল? আইবো না।’

সকাল থেকে টেলিভিশন চ্যানেল, সাহায্যকারীদল হিসেবে ছাত্রলীগ পরিচয় দেওয়া ছেলেদের ভিড় তখন বাড়তে শুরু করেছে।কারোর সঙ্গে একা কথা বলার উপায় নাই।একদিকে সরে গিয়ে দেখা যায়,কয়েকজন কিশোর পুড়ে যাওয়া জঞ্জাল উল্টে-পাল্টে দেখছে, যদি কিছু মেলে।

নিজেই ঘরের আশপাশ দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে রাহেলা বেওয়া বলেন, ‘কতবার আগুন ধরলো,প্রতিবারই পুরানরা অনেকে চলে যায়, নতুন নতুন মানুষও আসে। এমন ক্যারে।’

‘বছর খানেক আগে ধরবাইর পর (নয় মাস আগে) এমনই হসিল। আইসা কয় আগুন নাকি নিভসে। বুকের আগুন নেভে নাই। ডাকেন ফায়ার ব্রিগেডকে, নেভাক আগুন। দুই-দুইবার এই জায়গায় আমার যাকিছু ছিল সব আগুনের মুখে ‍পড়লো। কথাগুলো বলছিলেন নিকেতনে কাজ করেন এমন এক নারী, যিনি আগেও একবার নিঃস্ব হয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ছিলেন।

কড়াইল বস্তিআরেকটু এগিয়ে যেতেই একটা জটলা। কিছু মানুষ। কেউই কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। কাজে যাবেন না আজ  নিশ্চিত। কিন্তু থাকার জায়গাটা নিয়ে ভাবতে বসেছেন আশপাশের কয়েক ঘরের সবাই। পেছনে বসে থেকে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কাল খাইছেন কিছু? আহমেদ শহীদ মিয়া বললেন, ‘খাবার ছিল, গলা দিয়া নামে নাই। বাইচ্চাগুলারে খাওয়াইসি।’

সুমাইয়া নামে ১৩ বছরের এক মেয়ে টিনের নীচে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। এখনও গরম। পুড়ে যাবেতো বলতেই সে বলে, ‘আমার স্কুলের বেতন ছিল। এক টুকরা পাইসি। দেখেন, ছিল ।’ তার পাশেরই তার বন্ধু প্রায় পুরোটা পুড়ে যাওয়া একশ টাকার একটা নোট বের করে এনে, চোখে পানি ধরে রাখতে পারে না।

মধ্যবয়সী এক নারী বললেন, আপনারা আসবেন, আপনাদের কাজ। কিন্তু কিসু জিগায়েন না। এখান থেকে আমাদের ওঠাবে না জানি। কিন্তু বারবার আগুন লাগায়ে হিংসাহিংসি করে ক্ষমতাবানরা। আমরা অক্ষম।কিন্তু কান্দনের ছবি তুইলেন না। পরে একসময় আইসেন। আল্লাহ দিলে দেখা হবে এখানেই।

এপিএইচ/
আরও পড়ুন: 
আরও ৫ জঙ্গিকে গ্রেফতার করলেই শেষ হবে গুলশান হামলা মামলার তদন্ত