ভুট্টোর ‘বেসামাল আস্ফালন’ এর কড়া জবাব বাংলাদেশের

একাত্তর সালে প্রকাশিত পত্রিকা

১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বন্দি সেনাদের ছেড়ে দিতে আস্ফালনমূলক বক্তব্য দিয়েছিলেন দেশটির রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু পরদিনই সেই আস্ফালনের কড়া জবাব দেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি বলেন,‘পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালীদের বিচারের কোনও অধিকার পাকিস্তানের নেই। কারণ এটি সবরকম মানবিক রীতিনীতির পরিপন্থী।

ভুট্টোর হুমকি-ধামকির বিপরীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির স্পষ্ট জবাব নিয়ে প্রধান প্রতিবেদন করেছিল দৈনিক বাংলা। আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন,‘ভুট্টো সাহেব যদি এধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার দুঃসাহস দেখান তাহলে বাংলাদেশ জানে কিভাবে এ অবস্থার মোকাবিলা করতে হবে।’

পাকিস্তানি সেনাদের বিচার বাংলাদেশে করা হলে পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালীদের বিচার করা হবে বলে ভুট্টোর হুঁশিয়ারির জবাবে এই কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘তারা কোনও অপরাধ করেনি,তারা নেহাতই নিরীহ লোক। ভুট্টো এসব আটক নিরীহ বাঙালিদের বিচার করার হুমকি দিয়েছেন কেন? তার সকল যুদ্ধবন্দিকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের  দাবি কখনোই গ্রহণ করা হবে না।’

একাত্তর সালে প্রকাশিত পত্রিকা

১৯৭২ সালের ৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সরকারকে, বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানকে হুঁশিয়ার করে দেন তার দেশের সেনাদের যেন বিচারের আওতায় নেওয়া না হয়। এই দিনের (৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২) বাংলা ইংরেজি সব পত্রিকায় সে খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক বছর পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর এমন আচরণে স্তম্ভিত হয়েছিল সুশীল সমাজ।

এইদিনের ইত্তেফাকে প্রকাশিত, ‘ভুট্টোর বেসামাল আস্ফালন’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘পাকবাহিনীর আড়াইশত অফিসারের বিচার ব্যবস্থা করা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য অবিজ্ঞজনোচিত কাজ হইবে। বিবিসির কাছে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে জনাব ভুট্টো এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন যে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করিলে তিনিও অনুরূপ সংখ্যক বাঙালীর বিচারের ব্যবস্থা চালাইবেন।’


একাত্তর সালে প্রকাশিত পত্রিকা এই বক্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের অপরাধে অপরাধী পাক যুদ্ধবন্দিদের বিচার করা হলে ভুট্টো পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাঙালীদের বিচার করার হুমকি দিয়েছিলেন। তার বিপরীতে রাষ্ট্রপতি সাফ জানিয়ে দেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে হত্যাকারীরাই আজ বিচারের কথা বলছেন। যারা হত্যা-ধ্বংসলীলা চালানোর অপরাধে অপরাধী তারা অনুরূপ অভিযোগে নিরীহ বাঙালীদের বিচারের কথা বলছেন।
এ প্রসঙ্গে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তারা তাদের সেনাদের ফিরিয়ে নিতে হুমকি দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জবাব ছিল, কোনও ভাবেই তাদের বিনা বিচারে ফেরত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তারা পরবর্তীতে কথা দিয়েছিল দেশে নিয়ে গিয়ে এদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কিন্তু সেটা ছিল প্রহসন। বাংলাদেশের মাটিতেই তাদের বিচার করা দরকার ছিল।’
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন,‘পরাজিত ভুট্টো চাইবেই তার সৈন্যদের ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু সেজন্য তার দেশে আটকে পরা নিরীহ বাঙালীদের সে কিসের ভিত্তিতে বিচার করবে। তারা যুদ্ধকালে বাংলাদেশের পক্ষে ছিল বলে বিচার করা হবে বলে যে খোঁড়া যুক্তি দেওয়া হয়েছে এটা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য না। এবং এর বিপরীতে বাংলাদেশের যা করণীয় ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তা করা হয়েছে। অপরাধীর বিপরীতে নিরীহ আটকে পড়া বাঙালীদের বিচারের হুমকিও এক ধরনের অপরাধ। সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে।’
ছবি সৌজন্য: আইসিএসএফ এবং সিবিজিআর
/ইউআই /এএআর /আপ- এপিএইচ