মুক্তিযুদ্ধের নির্ভীক কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ

মহিউদ্দিন আহমেদ

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুধু দেশের মাটিতেই হয়নি, বিদেশের মাটিতেও হয়েছিল। আমাদের দেশের অনেক সাহসী কূটনীতিক নিশ্চিন্ত জীবনের পরোয়া না করে, চাকরির মায়া ত্যাগ করে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চোখরাঙানিকে পাত্তা না দিয়ে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অন্য লড়াইয়ে নেমেছিলেন।

এমন একজন সাহসী কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ। ১৯৭১’র ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এক সমাবেশে পাকিস্তানের পক্ষত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।

ইউরোপে তিনিই প্রথম পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করা বাংলাদেশি কূটনীতিক। সেই সময়ে তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা ছিল এবং ওই ঘটনার ২২ দিন পর ২৩ আগস্ট তার প্রথম সন্তানের জন্ম হয়।

বিজয়ের ক্ষণ আজও মহিউদ্দিন আহমেদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সকালে লন্ডনের ২৪ নম্বর পেমব্রিজ রোডে অবস্থিত তৎকালীন বাংলাদেশ দূতাবাসে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের খবরের জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করা কয়েকজন বাংলাদেশি কূটনীতিক। ছিলেন আরো অনেক বাংলাদেশি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘সে সময় পক্ষত্যাগকারি কূটনীতিকদের বলা হয়েছিল নিকটস্থ ভারতীয় দূতাবাসে যোগাযোগ করার জন্য এবং সম্ভব হলে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে বা লন্ডনের মিশনে যোগ দেওয়ার জন্য। সেদিন (১৬ ডিসেম্বর) আমি, রেজাউল করিম, মহিউদ্দিন জায়গীরদার, ফজলুল করিমসহ কয়েকজন কূটনীতিক এবং আরো কয়েকজন বাংলাদেশি স্টাফ মিশনে ছিলাম।’

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা আগেই জানতে পেরেছিলাম, পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। আমরা সুখবরটি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলাম। বাংলাদেশ সময় বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। লন্ডনে তখন সকাল। আত্মসমর্পণের কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা খবরটি জানতে পারি।’

একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই পাকিস্তানের পক্ষত্যাগ করার মতো দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের স্বীকৃতি পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা। তাই কূটনৈতিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করেছিলাম। আর তা সফল হয়েছিল সেদিন। পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সাংবাদিকসহ বাংলাদেশের অনেক মানুষ বাংলাদেশ মিশনে আসতে শুরু করে।’

বিজয়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘মনে পড়ে কয়েকজন সাংবাদিক মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন। সাংবাদিকরা এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে সুরাইয়া খানম নামে একজন বাংলাদেশি ছাত্রীকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। ডিসেম্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ আমরা খবর পাচ্ছিলাম যে তারা পিছু হটে যাচ্ছে। তবে আমরা বেশ ভয়ে-ভয়েও ছিলাম। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সেভেন্থ ফ্লিট বাংলাদেশে চলে আসলে আমাদের স্বাধীনতা পিছিয়ে যেতে পারতো।’

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সেই সময় আবু সাঈদ চৌধুরী (স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছিলেন। তাকে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সেভেন্থ ফ্লিট পাঠাতে পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন, সোভিয়েতরা তাকে বলেছিল যে তারা জানে আমেরিকা কতদূর যেতে পারবে। তারা সেভেন্থ ফ্লিট পাঠালে তার পিছু পিছু সোভিয়েত রাশিয়ার জাহাজও যাবে। তখন দুই পক্ষই ছিল সুপার পাওয়ার।’

১৯৭২’র ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে পৌঁছান। কনকনে শীতের মধ্যে ভোর পাঁচটার সময় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান বাংলাদেশের তিন কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ, রেজাউল করিম ও মহিউদ্দিন জায়গীরদার।

সেদিনের কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন ছিল সেটি। বঙ্গবন্ধুকে দেখে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। তিনি তখন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ভয় নেই, আমি এসে গেছি।’

এসএসজেড/এএআর/