সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এবছর ইফতারে গতানুগতিক আইটেমগুলো বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছেন অনেকে। যারা পুরোপুরি বাদ দিতে পারেনি, তারা এসব আইটেম কমিয়ে দিয়েছেন। এক সময় ছিল যখন রোজাদারদের কাছে ছোলা বুট, পিঁয়াজু, ঘুগনি, চপ, মুড়ি বেগুনি ছাড়া ইফতারের কথা ভাবাই যেতো না। কিন্তু এখন দেখা গেছে, ইফতারে একজন সচেতন রোজাদার শরবত ও সামান্য কিছু ফল-ফলারি খেয়ে হয়তো দই চিড়া খাচ্ছেন। শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে কেউ হয়তো হালিম খাচ্ছেন। কেউ হয়তো মাংস পরাটা খাচ্ছেন। কেউ সবজি রুটি খাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সরাসরি ভাত-সবজি-মাছ বা মাংস খাচ্ছেন। দেখা গেছে, রোজাদারদের অনেকেই এখন আর ইফতারের পর সন্ধ্যা রাতে ভাত খান না। ভাত তরকারি তারা খান একেবারে সেহরিতে। ফলে খাবারের আইটেম, রকম, ধরন প্রায় সবই বদলে গেছে। এ কারণেই অনেকে এখন আর আগের মতো ইফতারে মুড়ি, ছোলা, বেগুনি, চপ দিয়ে মাখানো মুড়ির গামলা বা ডিস নিয়ে বসেন না।
রাজধানীর রহমতগঞ্জে দেশের বড় ডালের পাইকারি বাজার। রমজানকে কেন্দ্র করে রহমতগঞ্জের প্রতিটি পাইকারি আড়তে সারি সারি বস্তা ভর্তি ছোলাসহ নানা প্রকার ডাল আনা হয়েছে। রমজানের অর্ধেকের বেশি শেষ হয়ে গেলেও আমদানিকৃত ছোলার ৬০ শতাংশও বিক্রি হয়নি।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে বলে ছোলা বিক্রি এ বছর কম। ছোলা পুষ্টিকর খাবার হলেও অনেকেই ইফতারে তেলে ভাজা খাবার এড়িয়ে চলতে গিয়ে ছোলা বাদ দিয়েছেন। বাদ দিয়েছেন বিভিন্ন প্রকার চপ ও বেগুনি, যা বানাতে বিভিন্ন প্রকার ডালের বেসন প্রয়োজন হয়। শুধু বেসনই নয়। এ জাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ ও রঙ—যা মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর। তাই এবছর শুধু ছোলা নয়, প্রত্যাশা অনুযায়ী নানা প্রকার ডালও রয়ে গেছে অবিক্রিত।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে রোজা পড়ায় ছোলাসহ তেলে ভাজা খাবার অনেকে খাচ্ছেন না, এর বদলে খাচ্ছেন মৌসুমি আম-কলা-আনারস-তরমুজসহ নানা ধরনের ফল। এ বছর তেলে ভাজা খাবার ছেড়ে চিড়া-দই-কলা বেছে নিয়েছেন অনেকে। এ কারণে এ বছর চিড়ার দাম অন্য যে কোনও বছরের তুলনায় বেশি বলে জানিয়েছেন রাজধানীর কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটের ব্যবসায়ী মেসার্স শুক্কুর ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. লাল মিয়া।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছেন। এ কারণে শুধু ছোলা বা চপ বা বেগুনি জাতীয় খাবারই নয়, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রঙ-বেরঙয়ের শরবতও ছেড়ে দিয়েছেন।
এ বছর বোতলে ভর্তি ট্যাং জাতীয় শরবত পরিত্যাগ করে লেবুর শরবত বেশি খাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন কাওরান বাজারের সবজি বাজারের লেবুর পাইকারি ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর লেবুর চাহিদা বেশি। তিনি জানান, শুধু গরম ও রোজার কারণেই নয়, মানুষের কাছে বোতলজাত শরবতের চেয়ে লেবুর শরবতের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এটি সচেতনতার কারণে।
এদিকে রহমতগঞ্জের ডালের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, অন্যান্য বছর এ সময়ে প্রায় প্রায় ৬০ শতাংশ ছোলা বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু এ বছরের চিত্র ভিন্ন। প্রত্যাশা অনুযায়ী ছোলা বিক্রি হচ্ছে না। প্রথম দিকে ক্রেতা আকৃষ্ট করতে ছোট ছোট বাটিতে বিভিন্ন প্রকার ও মানের ছোলার স্যাম্পল টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখলেও এ বছর ছোলার ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে বাটিতে না রেখে পানির গ্লাসে ভিজিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মানের শুকনা ছোলা। ভিজিয়ে রেখে ক্রেতাকে বোঝানো হচ্ছে, ভিজলে ছোলার রঙ ও সাইজ কতোটা পরিবর্তন হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ছোলাসহ এবছর নানা প্রকার ডালের বিক্রি অপ্রত্যাশিতভাবে কমে গেছে। মানুষ ছোলা খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করেছে। জানতে চাইলে তিনি জানান, ছোলা পুষ্টিকর খাদ্য হলেও এর সঙ্গে চপ, বেগুনসহ নানা জাতীয় তেলে ভাজা খাবার যুক্ত। তাই মানুষ তেলজাতীয় খাবার এড়াতে ছোলা বাদ দিয়েছেন।
রহমতগঞ্জের ডাল ব্যবসায়ী ও সমিতির সহ-সভাপতি নেছার আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় দেশে এ বছর ছোলাসহ সব ধরনের ডালের দাম কম। ফলের সিজন হওয়ায় পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর ফল। তাই এর চাহিদা কমেছে। তার ওপর গরম। সারাদিন রোজা রেখে অনেকে এই গরমে ছোলা খেয়ে হজম করতে পারেন না। এই সব কারণেই এ বছর ছোলার চাহিদা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কমেছে। ফলে কমে গেছে ছোলার বিক্রি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুখরঞ্জন বিশ্বাস বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। তাই দেখে, শুনে ও বুঝে মানুষ এখন খাবার খায়। তা ছাড়া ইফতারিতে ভাজা পোড়া খাবার না খাওয়াই ভালো। কেননা সারাদিন রোজা রাখার পর পেট খালি থাকে। এ অবস্থায় খালি পেটে তেলে ভাজা পোড়া খাবার গ্যাস্ট্রিক আলসারের সমস্যা তৈরিতে সহায়তা করে। এ ছাড়া নানা জাতীয় বোতলে ভরা ট্যাং জাতীয় শরবত মানবদেহের জন্য উপকারী নয়। তাই ইফতারিতে সরাসরি এক গ্লাস লেবুর শরবতই শ্রেয়।
/টিএন/আপ-এআর/