‘আয় দিয়ে বেতনই হয় না, উন্নয়ন হবে কিভাবে!’

 

ডিএসসিসিসদ্য বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৬-১৭) ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রাজস্ব আদায় প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এই অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই থেকে মে পর্যন্ত) বাজেটের চার ভাগের একভাগ রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে সংস্থাটি। তবে যে পরিমাণ আদায় হয়েছে, তা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অফিস পরিচালনা খরচ মেটানোও সম্ভব হয় না, উন্নয়ন হবে কিভাবে বলে প্রশ্ন তুলেছেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা !  

বাজেটে নির্ধারিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার জন্য সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করেছেন সাধারণ কর্মচারীরা। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজস্ব-কর্মীদের যে দুই/একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের কেউ-কেউ গ্রেফতার হয়েছেন। আবার অফিসিয়ালি অনেককে বদলিসহ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় মেয়র জিরো ট্রলারেন্সে আছেন।’

বাংলা ট্রিবিউনের হাতে পৌঁছা ডিএসসিসির বাজেট আয়ের হিসাব বিবরণী থেকে জানা গেছে, সদ্যবিদায়ী (১০১৬-১৭) অর্থবছরে তিন হাজার ১৮৩ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে নিজস্ব খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৬১৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এরমধ্যে অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে আয় হয়েছে ৪৩২ কোটি ৭১ লাখ ৪১ হাজার ৯০৭ টাকা। যা নিজস্ব বাজেট আয়ের মাত্র ২৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এছাড়া ৪২টি খাতের মধ্যে ৭টি থেকে কোনও টাকাই আসেনি।

এদিকে, সংস্থার প্রতিবছর বেতন ভাড়া, কর্মকর্তাদের যানবাহন ব্যয়, অফিস খরচ ও ভাড়াসহ নিয়মিত অন্যান্য ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। কিন্তু নগরবাসীর সেবা দিতে গিয়ে রাজস্ব আয় থেকেই তাকে ব্যয় করতে হয়। যে কারণে অনেক সময় উন্নয়ন কাজে হাত দিতে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতেও হিমশিম খেতে হয়।  

এ প্রসঙ্গে  নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিএসসিসির রাজস্ব আয় আশানুরূপ হয় না। মামলার কারণে আয়ের সব পথ বন্ধ। নিজস্ব তহবিলের কাজের বিল দিতে পারি না। জানি না আগামীতে বেতন দেব কিভাবে?  এই রাজস্ব আয় দিয়ে বেতন-ভাতাই হয় না, উন্নয়ন হবে কিভাবে?’

বাজেট আয়ের ওই নথি থেকে জানা গেছে, ডিএসসিসির মোট বাজেটের মধ্যে বাজার সালামি খাতে আয় ধরা হয় ৬৫০ কোটি টাকা। অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত এ খাতে আয় হয়েছে মাত্র ৭১ কোটি ৮০ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬৭ টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১১ শতাংশ। একই অবস্থা হোল্ডিং ট্যাক্সেও। এখাতে আয় ধরা হয় ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু আয় হয়েছে ১৫৩ কোটি ৭০ লাখ ৬৬ হাজার ৯৭৮ টাকা।

এই দুরবস্থা ট্রেড লাইসেন্স ফিতেও। এ খাতে আয় ধরা হয়েছে ৬৫ কোটি। কিন্তু আয় হয়েছে ৫৮ কোটি ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৮৬৬ টাকা। নগর ভবন, ছিন্নমূল শিশু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও নাট্যমঞ্চ ভাড়া খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আয় হয়েছে এক কোটি ৬৭ লাখ ৫ হাজার ৮৪১ টাকা। রাস্তাখনন ফি খাতে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮ কোটি টাকা। আয় হয়েছে ১২ কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার ২ টাকা। সম্পত্তি হস্তান্তর খাতের ৬৫ কোটি টাকা থেকে আয় হয়েছে ৪১ কোটি ৪৮ লাখ ৭৮ হাজার ৫২ টাকা।

এদিকে নিজস্ব আয়ের পাশাপাশি সরকারের কাছ থেকে বিশেষ বরাদ্দ পাওয়ার প্রত্যাশা রাখা হয়েছে, ২০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া সরকারি অনুদান থেকে ১৮ কোটি, অবিভক্ত  ডিসিসি থেকে ২ কোটি, স্থায়ী আমানতের সুদ থেকে ৩ কোটি, মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ৩০ লাখ ও রিকশা লাইসেন্স ফি ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা আয় ধরা হলেও অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে এ খাতগুলো থেকে কোনও আয় আসেনি।

ডিএসসিসির রাজস্ব আয়ের ৪২টি খাতের মধ্যে  গত অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে বাজার ভাড়া (সেলামি) ৩০ কোটি টাকা থেকে আয় হয়েছে ২২ কোটি ৩১ লাখ ১৯ হাজার ৭২২ টাকা, ভূমি সম্পত্তি ভাড়ার ১ কোটি টাকা থেকে ৪৬ লাখ ৩৯ হাজার ২৪৯ টাকা, পৌর ফিলিং স্টেশনের ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি ৩২ লাখ ৮ হাজার টাকা, প্রমোদ কর ৪৫ লাখ টাকা থেকে ৩৩ লাখ ৩ হাজার ৯৮৫ টাকা, বিজ্ঞাপন ১ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার ৪১৫ টাকা, বাস টার্মিনাল ৫ কোটি ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি ৪৯ লাখ ৭০ হাজার ১৩০ টাকা।

গরুর হাট ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা থেকে ৮ কোটি ৫৪ লাখ ৩১ হাজার ৫১ টাকা, পশু জবাইখানার ৩৮ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৭২০ টাকা, পৌর যন্ত্রপাতি ভাড়া ১০ কোটি টাকা থেকে ২ কোটি ৩ লাখ ৬০ হাজার ১২২ টাকা, শিশু পার্কের ৬ কোটি  ৭০ লাখ থেকে ৪ কোটি ৯ লাখ ১৬ হাজার  ৭০০ টাকা, সিডিউল ও অন্যান্য ফরম বাবদ ১ কোটি ২৫ লাখ থেকে ৭৯ লাখ ৬২ হাজার ৫৬৫ টাকা, কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া বাবদ ৩ কোটি টাকা থেকে ৮৮ লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৭ টাকা, কবরস্থান ও শ্মশানঘাট ৭০ লাখ টাকা থেকে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা, ক্ষতিপূরণ (নগরশুল্ক) ১ কোটি থেকে ১ কোটি টাকা ও বিয়ে ও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের ১ কোটি ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি ৮ লাখ ৪ হাজার ৩৫৫ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে ডিএসসিসির।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ হচ্ছে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় না হওয়া। আমরা ট্যাক্স পুনঃমূল্যায়নের হিসাব করেই লক্ষ্যমাত্রা ধরেছি। কিন্তু আদালতের একটি রিটের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের উদ্যোগটি যদি বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে ৪০০ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হতো।’  তিনি জানান, ‘আগামীকাল (মঙ্গলবার) মামলাটির শুনানি হবে। যদি রায় ডিসিসির পক্ষে আসে তাহলে, আগামী বছর থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনঃমূল্যায়ন করে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাবে। এ ছাড়া মার্কেট থেকেও রাজস্ব আয় বেশি ধরা হয়েছে।’ কয়েকটি মামলার কারণে তাও সম্ভব হয়নি বলেও তিনি জানান।

/এমএনএইচ/