টেকনাফ ও উখিয়ায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নিজ উদ্যোগেই সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের পর আর খাবার সংকটে পরছেন না। যারা টাকার অভাবে ক্যাম্পে যেতে পারছেন না, গাড়ি ভাড়ার টাকা দিয়ে তাদের ক্যাম্পে পাঠাচ্ছেন অনেক হৃদয়বান বাংলাদেশি।
নাফ নদী পার হয়ে যেসব রোহিঙ্গা শাহ পরীর দ্বীপে প্রাথমিকভাবে আশ্রয় নেন, স্থানীয় তরুণরা প্রথমেই তাদের জুস, শুকনা খাবার ও পানীয় দিচ্ছেন। এরপর বিভিন্ন যানবাহনে করে তাদের টেকনাফের দিকে পাঠানো হয়। সেখানে বাসস্টান্ডে এসে রোহিঙ্গারা জড়ো হন।
টেকনাফের মসজিদ মার্কেটের নিচে, হোটেলের সামনে, বাজারের বিভিন্ন দোকানের সামনে ও সড়কের ওপরে তারা অপেক্ষা করেন। সেখানে তাদের দুই-একদিন থাকতে হয়। এসময় তাদের খাবার ও পানীয় দেন এলাকার সাধারণ মানুষ।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি গত বৃহস্পতিবার বাসে করে কক্সবাজার যাচ্ছিলাম। তখন রোহিঙ্গাদের বিষয়টি জানতে পারি। এরপর টেকনাফে চলে আসি। নগদ দশ হাজার টাকা পকেটে ছিল, সব টাকা রোহিঙ্গাদের মাঝে ভাগ করে দিছি। এরপর টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আবার বিকাশ করে বাড়ি থেকে টাকা এনে তাও দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘ছোট ছোট বাচ্চা, বয়স্ক মানুষের এমন কষ্ট দেখে আমার খুব মায়া হয়েছে। কক্সবাজার শহরে না গিয়ে তাই বাস থেকে নেমে যাই। সৃষ্টিকর্তা জীবের সেবা করতে বলছেন। এই জীবের সেবা না করলে আর কোন জীবের সেবা করবো।’
এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এদের সহযোগিতা না করা নিষ্ঠুরতা। জীবন বাঁচাতে তারা এদেশে এসেছে। এখন এখানে যদি খাবার না পায়, তাহলে তারা কোথায় যাবে। আমরাওতো তাহলে মিয়ানমারের সমান হয়ে গেলাম। এখানে অনেকেই খাবার দিচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘সেদিন রাতে দেখি এক পরিবারের কাছে ভাড়া নেই, তাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ লোক । তিনি কাঁপতে ছিলেন, হাঁটতে পারেন না। তারপর আমি দশ জনকে গাড়ি করে দিয়েছি। তারা কুতুপালং গেছেন। এরকম আজকেও দিয়েছি।’
সবারই সামর্থ্য অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করা উচিৎ বলে জানে আলম সবাইকে মনে করিয়ে দেন। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে, ততটুকু সহযোগিতা করা উচিৎ বলেও মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী।
রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গারাও খাবার পেয়ে ক্ষণিকের জন্য স্বস্তি পান। যদিও তাদের চোখেমুখে বিরাজ করছে আতঙ্ক। স্বজন হারানোর বেদনায় তারা দিশেহারা। এখনও পথেই বসে আছেন অনেকে।
নতুন আসা রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগের জায়গা হয়েছে উখিয়া উপজেলার বালুখালী ঢাল পাহাড়ে ও টেকনাফের উনছি প্রাং পাহাড়গুলোতে। সেখানে তারা ছোট ছোট ঘর তুলে থাকা শুরু করেছেন। সেখানেও সাধারণ মানুষকে খাবার নিয়ে ছুটে আসতে দেখা গেছে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন রাজনৈতক সংগঠন ও ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ, ব্যবসায়ী, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশত শিক্ষার্থী রবিবার বালুখালী ঢাল পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন। খাবারের মধ্যে রয়েছে, চিড়া, গুড়, বিস্কুট, খাবার স্যালাইন ও মুড়ি। ট্রাকে করে তারা খাবার নিয়ে এসে দিনব্যাপী রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের সময় মানুষের পাশে দাঁড়াই। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই। তাদের আরও বেশি সহযোগিতা করা উচিৎ। এরা সবচেয়ে বড় অসহায়। তাই আমরা তাদের সহযোগিতা করতে এসেছি।’
তিনি বলেন, ‘তারা সংখ্যায় কত, তা বিবেচ্য বিষয় না। আমরা ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাত যদি তাদের একমুঠো করে খাবার দিতে পারি, তাহলে তাদের আর না খেয়ে থাকতে হবে না। আমাদের সবার একমুঠো করে খাবার দেওয়ার সামর্থ্য আছে। কারণ, আমাদের দেশে কেউ না খেয়ে থাকেন না।’
উখিয়ার পালংখালী এলাকায় ট্রাকে করে রোহিঙ্গাদের মাঝে পুরনো কাপড় বিতরণ করতে দেখা যায়। ১২/১৩ জন তরুণ ট্রাক থেকে কাপড় ছুড়ে রোহিঙ্গাদের দিকে দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা কক্সবাজার থেকে এসেছেন। পরিচিতদের কাছ থেকে পুরনো কাপড় সংগ্রহ করে তা তিনদিন ধরে রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করছেন। এই দলের একজন রাজ্জাক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা সবাই এক কাপড়ে আসছে। অনেকেরই ভেজা কাপড়। এজন্য তাদের জ্বরসহ বিভিন্ন ঠাণ্ডাজনিত রোগ হতে পারে। তাই আমরা চেষ্টা করছি, যাতে তারা একটু শুকনো থাকতে পারে। এতে নারী ও শিশুরা একটু হলেও নিরাপদ থাকবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষে এতগুলো মানুষকে নতুন কাপড় দেওয়া সম্ভব না। তাই পুরনো কাপড় দিতে বাধ্য হয়েছি। সবাই যদি এভাবে এগিয়ে আসেন, তাহলে আর কোনও সমস্যা থাকবে না রোহিঙ্গাদের।’
মো. ফোরকান হোসেন নামে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির দুই ছেলে শামসুল আলম ও জাফর আলম তাদের পুরো পরিবার কক্সবাজারের ঈদগাহ এলাকা থেকে ত্রাণ নিয়ে এসেছেন। এসময় তাদের পরিবারের নারী সদস্যরাও ছিলেন। সবাই রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করতে পেরে খুশি।
ফোরকান হোসেনের দুই ছেলেই ব্যবসায়ী। রোহিঙ্গাদের কষ্ট দেখে তারা সহ্য করতে পারেননি। চিড়া, চিনি, বিস্কুট ও জুস নিয়ে এসেছে এই পরিবারটি। মাইক্রোবাসের সামনে বসা ফোরকান হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কেউ ভিটেমাটি ইচ্ছায় ছেড়ে আসে না। তাদের পূর্বপুরুষের আবাস ভূমি ছেড়ে আমাদের কাছে এসেছেন। তাদের যদি আমরা সহযোগিতা না করি, তাহলে কারা করবে? আমার নাতি, নাতনি আছে। তারা যদি এমন কষ্ট পেত আমার কেমন লাগতো? আমি এসব বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালেই আমার ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পাই। তাই ছেলেদের বলেছি, ওদের সহযোগিতা করার জন্য। আমারতো অনেক আছে। ওদের সহযোগিতা করলে কমবে না।’
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালালে আশ্রয় নিতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ইতোমধ্যে এই হামলায় নারী শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। গত ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে।
আরও পড়ুন:
আমার সামনেই রোহিঙ্গাদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়: বিবিসি সাংবাদিকের ভাষ্য