রোহিঙ্গারা বলছেন, সমুদ্র ও নাফ নদী পেরিয়ে কয়েক ধাপ পার হয়ে আসতে হয় বাংলাদেশে। প্রথমে দালাল ঠিক করে নাফ নদীতে মাছ ধরার নৌকা জোগাড় করতে হয়। বাংলাদেশে আসতে তাদের জনপ্রতি গুনতে হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। পরিবারের সদস্য অনুযায়ী টাকা দালালদের হাতে দিলেই পারাপারের জন্য মেলে নৌকা। যারা টাকা দিতে পারছেন তারাই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন। আর যারা টাকা দিতে পারছেন না, তাদের অনেকেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে। আবার অনেকেই পাহাড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে অনাহারে-অর্ধহারে বেঁচে আছেন।
উখিয়ার ইনানীতে নৌকাডুবির ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গা নারী ফাতেমা বেগম বলেন, ‘মিয়ানমারে সীমান্ত এলাকায় নাফ নদীর পাড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। এদের কেউ অর্থের অভাবে আবার কেউ নৌকা না থাকায় নাফ নদী পার হতে পারছে না।’ গত বুধবার রাতে ফাতেমা তার স্বামী আবুল কালামসহ দুই শিশুসন্তান ও তিন মেয়েকে নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে বাংলাদেশে আসেন। ওই নৌকার প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে বাংলাদেশি ১০/২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে।
একই ঘটনায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া বুচিডং এলাকার নুরুল আলমের ছেলে সোনা মিয়া, মইডং এলাকার আব্দুল শুক্কুরের ছেলে নুরুল ইসলাম ও ইউছুপ আলীর ছেলে লালু মিয়াসহ অনেকে জানান, নৌকায় নারী,পুরুষ ও শিশুসহ ৮০ জনের অধিক যাত্রী ছিলেন। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হলেও তারা ভুলপথে ইনানী চলে আসে। এখানেই নৌকাটি ডুবে যায়।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল বলেন, ‘এক শ্রেণির দালাল টাকার লোভে মিয়ানমার থেকে অতিরিক্ত রোহিঙ্গা নিয়ে নাফ নদী পার হচ্ছে। এতে নাফ নদীতে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। জেলা পুলিশ এসব দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে প্রতারণার অভিযোগে এ পর্যন্ত ২৩০ দালালকে আটক করে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।’
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ইনানী সমুদ্রে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় ২০ জন মারা গেছে। কিন্তু, প্রশ্ন জাগে দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে কেন তারা ইনানী সমুদ্র উপকূলে এসেছিল? তারা কি মিয়ানমার থেকে সরাসরি কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল? নাকি অন্য কোনও কারণে ইনানী চলে এসেছে? এসব প্রশ্নের কারণ খুঁজছে প্রশাসন।’
টেকনাফ ২নং বিজিবির উপ-অধিনায়ক মেজর শরিফুল ইসলাম জমাদ্দার বলেন, ‘মানবতার অজুহাতে নৌকার মালিকরা অতিরিক্ত রোহিঙ্গা বোঝাই করে নাফ নদী পার হচ্ছে। বিশেষ করে রাতের আঁধারে দালালরা রোহিঙ্গাদের পারাপারের নামে টাকা ও মূল্যবান জিনিসপত্র হাতিয়ে নিচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এসব ঘটনায় বিজিবির সদস্যরা বেশ কিছু নৌকায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে ধ্বংস করেছে। একই সঙ্গে দালালদের খুঁজে বের করে আটক করা হচ্ছে।’
এদিকে, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) বৃহস্পতিবার রাতে ইনানী সমুদ্র উপকূলে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় ৬০ জনের বেশি মারা গেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, নৌকাডুবির ঘটনায় ২৩ রোহিঙ্গার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া, আরও ৪০ জন নিখোঁজ রয়েছে। ওই দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা এক রোহিঙ্গা বৃহস্পতিবার আইওএমকে জানায়, রোহিঙ্গাদের বহনকারী ওই নৌকায় ৫০ শিশুসহ প্রায় ৮০ জন রোহিঙ্গা ছিল। তারা সবাই সহিংসতার শিকার হয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছিল।
গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতন শুরুর পর থেকে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ২৬টির বেশি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ১১৬ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৫৭টি শিশুর পাশাপাশি নারী ৩৮ ও পুরুষ ২১ জন। মৃতদেহগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্থানীয় কবরস্থানগুলোতে দাফন করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে ইনানীতে নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত ২০ জনকেও স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবিত উদ্ধারদের টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হস্তান্তর করা হয়েছে।