সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ২০১৪ সালে প্রভাবশালীদের দখলে থাকা রাজধানীর ২৩টি স্কুলের তালিকা তৈরি করে। পরে এই কমিটির মাধ্যমে গঠিত উপ-কমিটি ওইসব স্কুল পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। গত দুই বছরে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিয়েছে। অথচ আজও সেসবের বেশিরভাগই বাস্তবায়ন হয়নি।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, ২৩টি স্কুলের মধ্যে ১২টির জায়গা দখল করে রেখেছেন স্থানীয় ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা। ৫টি স্কুলের জায়গা দখল করেছে অন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আর বেসরকারি কলেজ। এছাড়া ছোট কাটরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গা থাকলেও জরাজীর্ণ ভবনের কারণে অন্য স্কুলের কয়েকটি কক্ষে পরিচালিত হচ্ছে এর কার্যক্রম।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে টাউন হল মার্কেটের কাছেই সরকারি শাহীন প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের নামে ৩৬ শতাংশ জায়গা থাকলেও শুধু এর ভবনটির জায়গা মাত্র ৬ শতাংশ দখলে আছে। বেদখল হয়ে গেছে বাকি ৩০ শতাংশ জায়গা। স্কুলটির ভবনের সঙ্গে দখলদাররা আলাদা আবাসিক ভবন নির্মাণ করেছেন। মূল ফটকের কলাপসিবল গেটে ছাগল ও গরু বেঁধে রাখে প্রভাবশালীরা। দখলদারদের ছাদের পানি স্কুলের দেয়ালে পড়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভবনটি। জাকির হোসেন রোডে অবস্থিত স্কুলটির প্রবেশপথও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন দখলদাররা। সব মিলিয়ে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে কোনও স্কুল আছে!
সরকারি শাহীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজা আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এখানকার দখলদাররা বাঙালি নয়। তাদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা না করে সরকার স্কুলকে জায়গা ফিরিয়ে দিতে পারবে না বলে হাইকোর্টের আদেশ আছে। তিনি বলেন, ‘আমি স্কুলটিতে আসার পরে জানতে পারি এর ৩০ শতাংশ জায়গা আছে বেদখলে। এখনও স্কুলের ওপর অনেক ঝড় বয়ে যায়। স্থানীয়দের মধ্যে যেন শিক্ষার প্রতি কোনও শ্রদ্ধাবোধ নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ঠিকঠাক আসে না। যারা আসে তারাও অনিয়মিত। বর্তমানে এমন একটি পরিস্থিতি যে স্থানীয়রা পারলে স্কুলটাই দখল করে নেয়। সুযোগ পেলে হয়তো সেটাও করবে। বলতে পারেন আমরা খুবই খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে আছি। জানি না এর সমাধান হবে কবে।’
ঢাকার আরও অন্তত ১০টি স্কুলের পরিস্থিতি অনেকটাই এমন নাজুক। গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ৯ বছর ধরে ভাঙ্গারির দোকান ভাড়া দিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তি। এগুলো ব্যারিকেড তৈরি করেছে স্কুলের সামনে। এর চারপাশে অন্ধকার আর ঘিঞ্জি পরিবেশ। রাতদিন কলকারখানার শব্দ হয়। বর্তমানে এই স্কুলে শিক্ষার্থী খুবই কম। পরিবেশের কারণে প্রতি বছর এই সংখ্যা কমছে।
সূত্রাপুরের এমএ আলীম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা মাত্র ৫ শতাংশ। এর ওপর অবৈধ দখলদাররা দোকান বসিয়েছে। গাবতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পার্কিং হয় অবৈধভাবে।
পল্লবীর আ. মান্নান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশকিছু জমি অবাঙালিদের দখলে আছে। উত্তর কালশীর খলিলুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমির মালিকানা নির্ধারণ নিয়ে রয়েছে জটিলতা। পল্লবীর বনফুল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে স্থানীয়রা। তাদের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার সুপারিশ করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
যাত্রাবাড়ীর ব্রাহ্মণ চিরন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দখলদারকে জরুরি ভিত্তিতে উচ্ছেদ করার কথা বলা হয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশে। খিলগাঁও স্টাফ কোয়ার্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারি সার্ভেয়ার দিয়ে জমি মাপা হয়েছে। এখন দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া বাকি।
অন্যদিকে মতিঝিলের পিঅ্যান্ডটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা ১৮.৩৫ শতাংশ। কিন্তু প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ জায়গা দখল করে রেখেছে স্কুলটির সঙ্গেই অবস্থিত টিঅ্যান্ডটি উচ্চ বিদ্যালয়ের কিছু তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ও সাবেক প্রিন্সিপাল পাটোয়ারীর।
পিঅ্যান্ডটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক তানিয়া ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্কুলের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ জায়গা অনেক আগে থেকেই আমাদের দখলে নেই। টিঅ্যান্ডটি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক এক প্রিন্সিপাল স্কুলটির পূর্ব পাশে নিজে থাকার জন্য ঘর তুলেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পরও এখনও সেখানে তার পরিবার-স্বজনরা থাকেন বলেই জানি। আর স্কুলটির পশ্চিম পাশে টিঅ্যান্ডটি উচ্চ বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা ঘর বানিয়ে থাকেন।’
স্কুলটির বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে— স্কুলের কাগজপত্র সংগ্রহ করে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে হবে। এজন্য স্কুলটির নাম জারি হওয়া প্রয়োজন। আর নাম জারি করতে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন। নাম জারি হলেই উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব প্রসঙ্গে ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আরা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্কুলের বেদখল জায়গা উদ্ধারে প্রতিবন্ধকতা হলো এ নিয়ে আইনি জটিলতা। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তা প্রয়োজন। ফলে সব বিদ্যালয় পুরোপুরি দখলমুক্ত করতে সময় লাগছে। তবে আমরা ইতোমধ্যে অনেক বিদ্যালয়ের জমি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি। বাকিগুলোও দখলমুক্ত করতে কাজ চলছে।’