বেফাকের রাজনীতিকরণ, কমিটিতে প্রভাবশালী আলেমদের আত্মীয়স্বজন

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, বেফাক

দেশের বৃহৎ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) পড়েছে স্বজনপ্রীতি ও রাজনীতিকরণের মুখে। এই বোর্ডের দশম কাউন্সিলে ঘোষিত নতুন কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে প্রভাবশালী আলেমদের আত্মীয়স্বজনকে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিরাও বেফাকের দায়িত্বশীল পদ পেয়েছেন। বিশেষ করে কওমি বোর্ডের প্রধান আল্লামা আহমদ শফীর পুত্রকে কমিটিতে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন ঘটিয়ে শীর্ষ পদ দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ কারণে বেফাকের দশম কাউন্সিল বাতিলের দাবি তুলেছেন ময়মনসিংহের আলেমরা।

জানা যায়, আগের কমিটির তুলনায় কলেবরে বাড়ানো হয়েছে নতুন কমিটির সদস্য সংখ্যা। তবে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। অনেকেই বলছেন, ‘দ্বীনি শিক্ষায় স্বজনপ্রীতির বিরোধিতা করা হলেও এ ধরনের চর্চা দেশের সবচেয়ে বড় কওমি প্রতিষ্ঠানটিকে সঠিকভাবে পরিচালিত হতে বাধাগ্রস্ত করবে।’

এ বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে আবারও বেফাকের সভাপতি হয়েছেন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী। গত ১০ বছর ধরে এই পদে আছেন তিনি। রাজধানীর জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া ফরিদাবাদ মাদ্রাসায় বেফাকের দশম কাউন্সিল সভায় মজলিসে আমেলা (নির্বাহী কমিটি) ও শুরা কমিটি ঘোষণা করেন আহমদ শফী। এর মধ্যে নির্বাহী কমিটিতে আছেন ১১৬ জন, শুরা কমিটিতে আছেন ২৪২ জন। পদাধিকার বলে নির্বাহী কমিটির ১১৬ জন সদস্য শুরা কমিটিতেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। বেফাকের গঠনতন্ত্রে পাঁচ বছর পরপর কাউন্সিল হওয়ার নিয়ম রয়েছে। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত হয় বেফাকের নবম কাউন্সিল। তখন নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন ৫৫ জন, শুরা সদস্য ছিলেন ১৪৫ জন।

জানা যায়, দশম কাউন্সিলে ঘোষিত নির্বাহী কমিটিতে ২৭ জনকে সহ-সভাপতি করা হয়েছে। এছাড়া সহকারী মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছেন আটজন। মজলিসে আমেলার নতুন কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি হয়েছেন জামিয়া শরইয়্যাহ মালিবাগ মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আশরাফ আলী। মহাসচিবের দায়িত্ব পেয়েছেন জামিয়া ইমদাদিয়া ফরিবাদাদ মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আবদুল কুদ্দুস। ২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর বেফাকের পুরনো কমিটির মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদীর মৃত্যুর পর থেকেই বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মাওলানা আবদুল কুদ্দুস।

জানা গেছে, বেফাকের সভাপতি শাহ আহমদ শফীর ছেলে মাওলানা আনাস মাদানীকে সহ-সভাপতি ও তার জামাতা মাওলানা ইসহাককে সদস্য করা হয়েছে। মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের ভগ্নিপতি মুফতি নুরুল আমীনকে যুগ্ম মহাসচিব ও মহাসচিবের ভাই মাওলানা আব্দুল কাদিরকে সদস্য করা হয়েছে। মহাসচিবের বেয়াই মুফতি নেয়ামতুল্লাহকে যুগ্ম মহাসচিব পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মুফতি নেয়ামতুল্লাহ একইসঙ্গে আরেক যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হকের ভগ্নিপতি।

অন্যদিকে মাওলানা মাহফুজুল হকের ভাই মামুনুল হককে সদস্য করা হয়েছে। বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলীর জামাতা মাওলানা আতাউল্লাহ আমিনকে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন সহ-সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাসের ছেলে মাওলানা রশিদ আহমদ। মাওলানা মাহমুদুল হাসান সহ-সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন আর তার জামাতা মাওলানা নেয়ামত উল্লাহ ফরীদিকে শুরা কমিটির সদস্য করা হয়েছে।

আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী বেফাকের সহ-সভাপতি পদ পেলেও হেফাজতের মহাসচিব ও শায়খুল হাদিস হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরীকে বেফাকের মজলিসে আমেলার সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। আহমদ শফীর নিয়ন্ত্রণাধীন ‘আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলামের (হাটহাজারী মাদ্রাসা) অন্যতম প্রধান মুহাদ্দিস হলেন জুনাইদ বাবুনগরী। বয়োজেষ্ঠ না হয়েও একই মাদ্রাসার শিক্ষক আনাস মাদানী শুধু শফীর ছেলে হওয়ায় এই পদ পেয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

বেফাকে রাজনীতিকরণ

বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতারা বেফাকের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এসব নেতার কারণে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা ও মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বেফাকের নির্বাহী কমিটিতে রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামা ইসলাম, খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। আগের নির্বাহী কমিটির চেয়ে এবার আরও বেশি স্থান পেয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা।

বেফাকের মজলিসের আমেলার তালিকায় দেখা গেছে, বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী হলেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান। বেফাকের সহ-সভাপতির মধ্যে রয়েছেন জমিয়তে মহাসচিব মাওলানা নূর হোসেন কাসেমী, জমিয়তের একাংশের আমির মুফতি ওয়াক্কাস, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, ইসলামী ঐক্যজোটের সহ-সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ।

বেফাকের সহকারী মহাসচিবদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুযুল হক, জমিয়তের সহকারী মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী, জমিয়তের ঢাকা মহানগরের নেতা মাওলানা কেফায়েতুল্লাহ আজহারী।

বেফাকের সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মাওলানা ওবায়দুর রহমান, ইসলামী ঐক্যজোট নেতা আনওয়ারুল করিম, জমিয়ত একাংশের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা রশীদ আহমাদ, জমিয়ত নেতা মাওলানা মাসউদুল করীম।

বেফাকের আমেলার সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসনাত আমিনী, জমিয়ত নেতা মাওলানা মাসউদুল করীম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা সাঈদ নূর, খেলাফত মজলিসের সহ-সভাপতি মাওলানা যুবায়ের আহমাদ চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলনের নেতা নূরুল হুদা ফয়েজী, ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মাওলানা গোলাম রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সহ-সভাপতি মাওলানা যোবায়ের রহমান, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতা মাওলানা লেহাজ উদ্দীন, মাওলানা নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব আতাউল্লাহ আমিন, জমিয়ত একাংশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম।

বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসা ও বেফাক সূত্রে জানা গেছে, বেফাকের প্রতিষ্ঠাকালীন গঠনতন্ত্রে মূলনীতি ছিল—কোনও দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদে থাকতে পারবেন না। নিয়ম অনুযায়ী বেফাকের মজলিসে আমেলার সদস্য করা হয় মাদ্রাসার মুহতামিমদের (অধ্যক্ষ)। তবে নব্বই দশকে এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় এলে রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রভাব বিস্তার শুরু হয় বেফাকে। বেফাকের মজলিসে আমেলায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক স্বার্থে বেফাককে ব্যবহার করেন নেতারা। বেফাকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও রয়েছে রাজনৈতিক দলের প্রভাব।

জানা গেছে, ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের বিভিন্ন মাদ্রাসার মুহতামিমের (প্রধান শিক্ষক) মতবিনিময় সভা হয়েছে। সেখানে ইত্তেফাকুল উলামা বৃহত্তর ময়মনসিংহের মজলিসে আমেলার সভাপতি খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী বেফাকের কমিটি বাতিলসহ ছয় দফা দাবি পেশ করেন। সভায় বেফাকে আত্মীয়করণের সমালোচনা করেন আলেমরা।

এ প্রসঙ্গে খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমরা ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছি। দশম কাউন্সিলের কার্যক্রম গঠনতান্ত্রিকভাবে হয়নি। তাই ঘোষিত কমিটি বাতিল করে নতুন কাউন্সিলের ব্যবস্থা করতে হবে। বেফাকে ‘মজলিসে খাস’ নামে একটি কমিটি আছে। এটি বাতিল করা দরকার। প্রতি জেলার বেফাকভুক্ত মাদ্রাসার সংখ্যানুপাতে শুরা ও আমেলায় সদস্য নিয়োগ দিতে হবে।”

কমিটি গঠনে স্বজনপ্রীতি প্রসঙ্গে বেফাকের মহাসচিব মাওলানা আবদুল কুদ্দুস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুই-একটি পদে এমন হয়ে থাকতে পারে, যা আমাদের আগে জানা ছিল না। তবে আগামী বৈঠকে এসব সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।’

এসব প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করা হলে বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।