হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’র স্বীকৃতি আছে, অধিকার নেই

জোনাক হিজড়া ও ববি হিজড়া

সরকার হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু সুবিধা দেয়নি। উল্টো নতুন-পুরনো পরিচয়ের দ্বন্দ্বে নানা রকমের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন দেশের হিজড়া জনগোষ্ঠী।

তারা বলছেন, কোথাও এই স্বীকৃতি কাজে আসছে না। বরং স্বীকৃতির পর কমেছে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি।

২০১৩ সালে হিজড়া জনগোষ্ঠী তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। গেজেটে বলা হয়, ‘সরকার বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে হিজড়া লিঙ্গ (Hijra) হিসাবে চিহ্নিত করিয়া স্বীকৃত প্রদান করিল।’

হিজড়া পরিচয়ে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে এই স্বীকৃতির দাবি ছিল হিজড়া সম্প্রদায়ের। তবে স্বীকৃতির পাঁচ বছরেও এই পরিচয়ে তাদের কোনও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত হয়নি।

সরকারের স্বীকৃতির পর দেশের বিভিন্ন অফিস, আদালত, দফতর, অধিদফতর ও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর নিজস্ব বিধির পরিবর্তন না আনায় হিজড়া জনগোষ্ঠী আলাদা লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর কর্মকর্তারা।

বিধিমালা পরিবর্তন না হওয়ায় এখনও এই মানুষেরা তাদের স্বীকৃত পরিচয়ে ভোটার হতে পারছে না। তবে আগামী জুলাইয়ে ভোটার হালনাগাদ করার সময় তারা ভোটার হতে পারবেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক আব্দুল বাতেন।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,’আমরা আইন ও বিধিমালা পরিবর্তনের পদক্ষেপ নিয়েছি। আশা করছি দ্রুতই হিজড়া জনগোষ্ঠী হিজড়া পরিচয়ে ভোটার হতে পারবেন। তাদের জন্য বিধিমালায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে।’

স্কুল, কলেজের শিক্ষার সনদ থেকে শুরু করে সমস্ত কাগজপত্রে হিজড়ারা পুরুষ পরিচয় দিয়ে থাকেন। এখন লৈঙ্গিক পরিচয় বদল করার জন্য হলফনামা করতে গিয়ে তারা বিপদে পড়ছেন। যেমন চৈতি নামে এক হিজড়া ছেলে পরিচয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। তিনি হিজড়া পরিচয়ের জন্য অ্যাফিডেভিট করতে গেলে তিনি যে হিজড়া সেই প্রমাণ চাওয়া হয়।

চৈতি সরকারি কোনও চাকরি না পেয়ে নিজেই রাজবাড়ী এলাকায় হিজড়াদের অধিকার আদায়ে কাজ করেন বলে জানা যায়।

অপরদিকে, পাসপোর্টে এখনও হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ বলে কোনও আলাদা স্বীকৃতি মেলেনি। এখনও তারা ‘নারী, পুরুষ অথবা অন্যান্য’ হিসেবে পাসপোর্ট ফরম পূরণ করেন। তবে সেখানেও সমস্যা হয়। কারণ অনেকেই জাতীয় পরিচয়পত্র পুরুষ পরিচয়ে নিয়েছেন।

সরকারি চাকরিতে হিজড়া পরিচয়ে কেউ এখনও চাকরি পাননি। হয় পুরুষ অথবা নারী পরিচয়ে চাকরি পেয়েছেন এমন হিজড়া রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সার্কুলারের সময় ২০১৪ সাল থেকে আমরা বিজ্ঞাপণন তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া হিজড়াদের আবেদন করার সুযোগ দিয়ে আসছি। তারা হিজড়া পরিচয়ে আবেদন করতে পারেন।’

তবে হিজড়া পরিচয়ে এখন পর্যন্ত কেউ আবেদন করেনি বলে জানিয়েছেন পিএসসসি’র পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আ ই ম নেছার উদ্দিন। তিনি বলেন,‘সুযোগ থাকলেও তারা এখনও কেউ আবেদন করেনি।’

তবে হিজড়াদের দাবি, তারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে কোটা চান। শুধু হিজড়াদের জন্য কোটা চান তারা।

সুযোগের অভাবে এখনও ভিক্ষাবৃত্তি ও যৌন পেশাই তাদের জীবন জীবিকার মূল উপার্জনের উপায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস তার একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধে বাংলাদেশের হিজড়াদের আদি পেশা ও জীবন ধারণের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন।

প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘নবজাতক শিশুদের আশীর্বাদ করে, নাচ-গান করে, বাদাইখাটার (ভিক্ষার ন্যায় টাকা নেওয়া) মাধ্যমে আয় করে থাকেন তারা।’

তবে বাদাইখাটা এখন চাঁদা আদায়ের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবহন ও রাস্তায় মানুষকে টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। মানুষ বিব্রত হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে তাদের টাকা দিচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাফিক সিগনালগুলোতে এই চিত্র দেখা যায়।

শেরাটনের মোড়ে চাঁদা নেওয়ার সময় রেবেকা নামে এক হিজড়া বলেন, ‘বাধ্য হয়েই আমি ভিক্ষা করছি। কারণ আমাদের কেউ বাসা বাড়ির কাজেও নেয় না।’

পরিবহনে হিজড়াদের চাঁদা নেওয়ার বিষয়টি হিজড়া জনগোষ্ঠীরও অনেকে সমর্থন করেন না। তেমনই একজন ববি হিজড়া। রাজধানীর শ্যামপুরের বরাইতলা নামক এলাকার একটি জলার ওপর বাঁশের ঘর তুলে থাকেন। সেখানে ২৫-৩০ জন হিজড়ার জন্য কয়েকটি খুপড়ি ঘর আছে। এদের গুরু-মা ববি হিজড়া (৫৫)। তিনি বলেন, ‘চাঁদা তোলার বিষয়টি প্রায়ই শুনতে হয়। এটা আমরা নিষেধ করি। কিন্তু হিজড়াদের স্বীকৃতির পর কোনও কিছুই অগ্রগতি হয়নি। সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে কিন্তু সেই স্বীকৃতি কেবল সচিবালয়ের কাগজে। বাইরের চিত্র ভিন্ন।’

স্বীকৃতির পর সাধারণ মানুষও মনে করছেন সরকারের কাছ থেকে হিজড়া জনগোষ্ঠী অনেক সুবিধা পাচ্ছেন। তাই তাদের সহানুভূতির জায়গা কমে আসছে বলেও তিনি জানান।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হিজড়াদের বড় অংশই দরিদ্র। তাদের মধ্যে শিক্ষার হার কম এবং অন্য কাজেও তাদের দক্ষতা কম। এদের বেশির ভাগই যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে তারা রাস্তাঘাটে ভাসমান যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেন। কেউ কেউ বাসাবাড়িতেও এই ব্যবসা করেন।

সচেতন সমাজ সেবা হিজড়া সংঘের সভানেত্রী ইভান আহম্মেদ কথা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের আদি পেশা নেই। দুই দশক আগেও গ্রামে হিজড়াদের কদর ছিল। গান বাজনার জন্য মানুষ নিজেরাই ডাকতো। এখন আর কেউ ডাকে না। হিজড়ারা তাই ভিক্ষাবৃত্তি করছে।’

হিজরা জনগোষ্ঠীকে এখনও কোনও রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনও সুবিধা নিতে হলে তাদের ক্ষেত্রবিশেষ পুরুষ, আবার কখনও নারী পরিচয় দিতে হচ্ছে। তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয় দিয়ে কোনও সুবিধা মিলছে না বলেও জানান তিনি।

সেবাদানকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কাউকে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ পরিচয়ে কোনও সেবা দেওয়ার সুযোগ এখনও নেই।  রাষ্ট্রের সেবা পেতে গেলে এখনও একজন হিজড়াকে ‘নারী অথবা পুরুষ’ হয়ে যেতে হয়।

জানা যায়, সমাজ এবং পরিস্থিতির চাপে হিজড়ারা মূলত পরিবার ছেড়ে আসে ১৩-১৪ বছর বয়স হতে না হতেই। যখন একজন মানুষের নিজেকে তৈরি করার বয়স, তখন ঘর ছেড়ে, বাবা-মা ছেড়ে চলে আসতে হয় তাদের। এরকমই একজন হিজড়ার নাম পাখি। তিনি শ্যামপুরের বরাইতলায় থাকেন। ছেলে পরিচয়ে রাজধানীর রামপুরাতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়াও করেছেন। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোট। বাবা ইতালী প্রবাসী।

পাখি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছি। কিন্তু সবাই আমাকে বিভিন্ন কথা বলতো। তাই ২০০৮ সালে বাসা থেকে বের হয়ে আসছি।’ বিভিন্ন কারণে কয়েকবার আত্মহত্যা করতেও চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারই পরিবার ও স্বজনদের সহযোগিতায় বেঁচে যান।

হিজড়া সন্তান যে সমাজের বোঝা না তাও দেখিয়েছেন অনেকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমানে অনেক হিজড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, এমনকি উদ্যোক্তা হিসেবেও সফল হচ্ছেন। এমন অনেক ঘটনা আছে, যারা এখন পরিবারের হালও ধরেছেন। এমনই একজন জোনক হিজড়া। তিনি স্নাতক শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। মাকেও দেখাশোনা করছেন।

হিজড়াদের বিভিন্ন রোগের ঝুঁকির কথা প্রায়ই আলোচনায় আসে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, খাদ্য সংকট, পুষ্টির অভাব ও যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করায় বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণও রয়েছে। হিজড়া জনগোষ্ঠী ভ্রাম্যমাণ। উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তাদের যাতায়াত রয়েছ। একারণেও বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিও রয়েছে।

হিজড়াদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজ সেবা অধিদফতর প্রকল্পগুলো দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করে থাকে। তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, ভাতা ও কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তবে তাতে দৃশ্যমান কোনও উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

বর্তমান উত্তরাধিকার আইনে হিজড়ার কোনও স্বীকৃতি নেই। তবে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবিষয়ে একটি আইনের খসড়া করেছে বলে কর্মকর্তারা বলেছেন।

সরকার বলছে, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নের জন্য নানা রকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সমাজ কল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা হিজড়া জনগোষ্ঠীকে ভাতা দিচ্ছি, প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, উপবৃত্তি দিচ্ছি। ধীরে ধীরে তাদের জন্য গৃহীত প্রকল্প বড় হচ্ছে। আগামীতেও বাড়বে।’

যে সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত কিনা এর জবাবে তিনি বলেন,‘বিধবা ও বয়স্ক ভাতার হারেই তাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এটা সহায়তা ভাতা। এটা কোনও বেতন না।’

সরকারি চাকরিতে হিজড়া জনগোষ্ঠীর আলাদা কোটার দাবির বিষয়ে তিনি বলেন,‘এই মুহূর্তে তৃতীয় লিঙ্গের জন্য আলাদা কোনও কোটার কথা আমরা ভাবছি না। তবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে তারা যে সুযোগ ‍সুবিধা পায়, তা পেতে থাকবে।’