সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে ইসি

নির্বাচন ভবনএকাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতির পথে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এরই অংশ হিসেবে সীমানা পুনঃনির্ধারণসহ নির্বাচনি যাবতীয় কর্মকাণ্ড গুছিয়ে আনছে এই সাংবিধানিক সংস্থাটি। পাশাপাশি রবিবার (৫ আগস্ট) ভোট কেন্দ্রের খসড়া প্রকাশ করেছে। দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করে চূড়ান্ত কেন্দ্র তালিকা। পাশাপাশি নির্বাচনি সামগ্রী কেনা, ভোটার তালিকা মুদ্রণ, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম এগিয়ে চলতে দ্রুত গতিতে। অবশ্য এতসব প্রস্তুতির মধ্যেও কমিশন গণ-প্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনসহ রোডম্যাপের পরিকল্পনার কয়েকটি বিষয় সম্পন্ন করতে পারেনি। এদিকে আরপিও সংশোধনের বাধ্যবাধকতা থাকায় কমিশনের জোরালো প্রস্তুতি থাকলেও সংসদ নির্বাচনে  ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নির্বাচন কমিশনের কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদা মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি আগে থেকেই রয়েছে। নির্বাচন তো করতেই হবে। আমাদের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অক্টোবরের দিকে তফসিল ঘোষণা শুরু হবে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ বা জানুয়ারির প্রথম দিনে নিয়ম অনুসারে যেটা হয়, তখন নির্বাচন হবে। জানুয়ারির ২৮ তারিখের মধ্যে ভোট হবে। তবে, কমিশনে এখনও এটা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত পরে হবে।’

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী দশম সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ববর্তী ৯০দিনের মধ্যে ১১তম সংসদ  নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি দশম সংসদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই হিসাবে আগামী বছরের ২৮ জানুয়ারির পূর্ববর্তী নব্বই দিন অর্থাৎ এ বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের কাউনডাউন শুরু হবে।

ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচনি মালামাল তথা স্ট্যাম্প প্যাড, অফিসিয়াল সিল, মার্কিং সিল, ব্রাশ সিল, লাল গালা, আম কাঠের প্যাকিং বাক্স, অমোচনীয় কালী ইত্যাদি কেনাকাটা ও ব্যালট পেপার, বিভিন্ন ফরম, প্যাকেট, নির্দেশিকা, ম্যানুয়াল ছাপানোর কাগজ ক্রয়সহ অন্যান্য কাজ এগিয়ে চলেছে। মালামালের একটি অংশ ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকিগুলোর কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে। জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের জন্য ৩৪ লাখ ৪০ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, ৬ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ স্ট্যাম্পপ্যাড, ১৭ হাজার ৪২০ কিলোগ্রাম লাল গালা, ৫ লাখ ৭৮ হাজার অফিসিয়াল সিল, ১১ লাখ ৫৬ হাজার মার্কিং সিল, ৮৭ হাজার ১০০ ব্রাশ সিল, ৬ লাখ ৬৫ হাজার অমোচনীয় কালীর কলম কেনা হবে। এ নির্বাচনের জন্য প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার রিম কাগজ প্রয়োজন হবে বলে কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচনের পরপরই দেশের সবগুলো উপজেলা পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যে কারণে দুটি নির্বাচনের সামগ্রী কমিশন একইসঙ্গে সংগ্রহ করার উদ্যোগ নিয়েছে।

এদিকে ভোটের মালামাল কেনার পাশাপাশি নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। কমিশন থেকে কর্মকর্তাদের ইভিএম মেশিন ব্যবহার বিষয়ে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে মাস্টার ট্রেইনার প্রস্তুত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ইউনুচ আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিশন থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ইভিএম ব্যবহার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আমার অঞ্চলের কর্মকর্তাদের একটি অংশ ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে ইউনুচ আলী বলেন, ‘নির্বাচনের সময় প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের দরকার হয়, তার জন্য পৃথক মাস্টার ট্রেইনার ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন পড়ে না। তাদের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আগে থেকেই প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ।’

এর আগে নির্বাচন কমিশন গত ৩০ এপ্রিল ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানার গেজেট প্রকাশ, ৩১ জানুয়ারি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশসহ তাদের রুটিন ওয়ার্কগুলো চালিয়ে যাচ্ছে। ভোটার তালিকার সিডিও প্রস্তুতির কাজও এগিয়ে চলছে।

ভোটকেন্দ্র প্রস্তুত: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কমিশন রবিবার (৫ আগস্ট) ভোট কেন্দ্রের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে। এসব ভোটকেন্দ্রের বিষয়ে আগামী ১৯ আগস্ট পর্যন্ত দাবি-আপত্তি জানানো যাবে। ৩০ আগস্ট এসব দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি করে ৬ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রকাশ করা হবে।

জানা গেছে, এবার নির্বাচনে ৪০ হাজারের মতো ভোট কেন্দ্র হতে পারে। যা বিগত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে তিন হাজার বেশি। নবম সংসদে ভোটকেন্দ্র ছিল ৩৫ হাজার ২৬৩টি। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ৩শ’ সংসদীয় আসনের সমতল এলাকায় ৩৯ হাজার ৩৮৭টি এবং পার্বত্য এলাকায় ৬১৩টি ভোট কেন্দ্র থাকছে। ভোটকক্ষ হবে প্রায় দুই লাখ। ভোটকেন্দ্রের নীতিমালা অনুযায়ী, গড়ে আড়াই হাজার ভোটারের জন্য একটি করে ভোটকেন্দ্র এবং গড়ে ৬০০ পুরুষ ভোটারের জন্য ও ৫০০ নারী ভোটারের জন্য একটি করে ভোট কক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে দেশে ভোটার ১০ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৩৮১ জন।

অর্থের সংস্থান: আসন্ন সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে তার অর্থের সংস্থান সম্পন্ন করেছে। কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী গেলো সংসদ অধিবেশনে সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের জন্য তারা এবার বাজেটে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। এর মধ্যে সংসদ নির্বাচনের জন্য ৬৭৫ কোটি টাকা, উপজেলা পরিষদের জন্য ৫৭৫ কোটি টাকা, পৌরসভার জন্য ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য ১১ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। এছাড়া অবশিষ্ট অংশ অন্য নির্বাচন/উপনির্বাচনের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে।

ইভিএম না হলেও থাকলে প্রস্তুতি: আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিং ভোটিং মেশিন) ব্যবহারের সম্ভাবনা না থাকলেও কমিশন এর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ইতোমধ্যে আড়াই হাজার ইভিএম মেশিন কিনেছে কমিশন। এগুলোর একটি অংশ তারা সদ্য অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছে। এছাড়া ইভিএম ব্যবহারের জন্য দক্ষজনবল তৈরি করতে কমিশন তাদের মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে গড়ে তুলেছে। অবশ্য ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইভিএম ব্যবহারের সঙ্গে আরপিও সংশোধনীর সম্পর্ক রয়েছে। কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ভোট গ্রহণের বিধান থাকলেও সংসদ নির্বাচনি আইনে এই বিধান অন্তর্ভুক্ত নেই। কাজেই এটা করতে হলে তার আগে অবশ্যই আরপিও সংশোধন করে এটা যুক্ত করতে হবে। তাদের এই মুহূর্তে যেহেতু আরপিও সংশোধনের পরিকল্পনা নেই ফলে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনা নেই। 

হচ্ছে না আরপিও সংশোধন: নির্বাচন কমিশন তার রোডম্যাপে গেলো ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর পরিকল্পনার কথা জানালেও এখনও  হয়নি। আরপিও সংশোধনের জন্য কমিশন একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটির মাধ্যমে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো তৈরি করলেও শেষ সময়ে তা নাকচ হয়ে যায়। ফলে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে আরপিও সংশোধনীর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ এর ইঙ্গিতও দিয়েছেন। ওই সময় বাংলা ট্রিবিউনসহ একাধিক গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়া তিনি বলেন, ‘কমিশনের এই মুহূর্তে আরপিও সংশোধনীর পরিকল্পনা নেই। আরপিও ছাড়াও রাজনৈতিক দলের চূড়ান্ত নিবন্ধন তালিকা প্রকাশসহ ইসি তার রোডম্যাপে কিছু কাজে পিছিয়ে রয়েছে।’

নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের সবধরনের প্রস্তুতি গুছিয়ে এনেছি। কিছু কাজ চলমান রয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগেই তা আমরা সম্পন্ন করতে পারবো।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা অত্যন্ত দক্ষ। তাদের একাধিক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে প্রস্তুতিতে কোনও ঘাটতি থাকার সুযোগ নেই।’

ইভিএম বিষয়ে হেলালুদ্দীন বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। তবে, জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। স্টেকহোল্ডারদের অভিমতের বিষয় রয়েছে। এসব বিবেচনায় কমিশন যে সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই বাস্তবায়ন করা হবে।’

রোডম্যাপ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে ইসি সচিব বলেন, ‘রোডম্যাপের অধিকাংশই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আর যদি কোনোটির ক্ষেত্রে ঘাটতিও থাকে, তা জাতীয় নির্বাচনে কোনও প্রভাব ফেলবে না।’