জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে বিদেশি সাহায্য আসতে শুরু করে। বাংলাদেশের দুস্থ জনগণের সাহায্যের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে যৌথ কর্মসূচি হাতে নেয় জাতিসংঘ। জীবনদানকারীদের পরিবারের সদস্যদের জন্য পুনর্বাসনের সব ধরনের ব্যবস্থার আশ্বাস দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদিকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়— ‘এরপরে কারও কাছে অস্ত্র পাওয়া গেলে তিনি পকিস্তান বাহিনীর দোসর আলবদর, আল শামস,রাজাকার সংস্থার কিনা সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হবে।’
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ জরিপ
জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের জনগণের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে শুভেচ্ছা জানান। জাতিসংঘের সাহায্য ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত সহ-মহাসচিব পল মার্ক সাক্ষাৎ করে বঙ্গবন্ধুকে এই শুভেচ্ছা বার্তা দেন। বাংলাদেশের দুস্থ জনগণের সাহায্যের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে জাতিসংঘ যৌথ কর্মসূচি হাত নিয়েছে বলেও জানান তিনি। মার্ক সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে সহায়তা জোরদার করতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা যৌথ তথ্য সংগ্রহের কাজও করছে।
পুনর্বাসনের আশ্বাস
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তির জন্য জীবনদানকারীদের পরিবারের সদস্যদের জন্য পুনর্বাসনের সব ধরনের ব্যবস্থা করবে সরকার। বাসস জানায়, পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নিহত সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বঙ্গবন্ধু এই আশ্বাস দেন। তারা বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেন। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু অশ্রুরোধ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু নিহতদের স্বজনদের বলেন, ‘আমরা তাদের বীরত্বে গর্বিত। তাদের ত্যাগের মূল্য দিতে আমি আমার সাধ্য মতো করবো।’
২৮ জানুয়ারির পর অস্ত্র বেআইনি
১৯৭২ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে গণবাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এরপরও যারা অস্ত্র জমা দেবেন না, তাদের পরিণতি নিয়েও হুঁশিয়ারি জানানো হয়। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু এই নির্দেশনা দেন।
অবশেষে ভাসানী আসছেন
বামপন্থী নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ২২ জানুয়ারি দেশে ফিরছেন বলে ২০ জানুয়ারি শুক্রবার দৈনিক বাংলা খবর প্রকাশ করে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পিকিংপন্থী ৮৯ বছর বয়সী এই নেতা ১৯৭১ এর এপ্রিলে ভারত চলে যান। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভাসানী সব সময় বলতেন, শেখ মুজিব অনুরোধ করলেই কেবল তিনি দেশে ফিরবেন। অবশেষে শেখ মুজিবুর রহমান তাকে দেশে ফেরার আহ্বান জানান। ভাসানী একজন বিপ্লবী নেতা। দৈনিক বাংলায় তার আগমনের খবরে বলা হয়, তিনি সাংবাদিকদের সামনে বলেছেন, পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জনের আগে তিনি নিজে অন্তত ডজনখানেক বৃটিশ অফিসারকে হত্যা করেছেন।
২৬ মার্চ নির্ধারিত হলো স্বাধীনতা দিবস
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ২৬ মার্চকে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের পরের দিন দেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বিজয়ের একমাস পর ১৯ জানুয়ারি বছরের ছুটির তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালনের ঘোষণা দওয়া হয়।
বাংলাদেশ সরকার সব প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুল, সব মাধ্যমিক ও ডিগ্রি কলেজের বর্তমান ম্যানেজিং কমিটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে বলা হয়— শহর এলাকার বিদ্যালয়গুলো অ্যাডহক কমিটি গঠন করবে। এই কমিটিতে পাঁচ জনের বেশি সদস্য থাকবে না। স্থানীয় এমসিএ-দের সঙ্গে আলোচনা করে কমিটি হবে। সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে এসব প্রতিষ্ঠানে অ্যাডহক কমিটি গঠন করবে। কমিটির মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ছয় মাস।
সর্বস্তরে বাংলা নিশ্চিত করতে ছাত্রনেতাদের চাপ
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন যৌথ বিবৃতিতে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তারা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, আইন-আদালতে বাংলা চালুর অনুরোধ করেন। তাদের দাবি— বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ভাষায় পরিচালিত বিদ্যালয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলা চালু হতে হবে। ফেব্রুয়ারি মাসে সেটি মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিবৃতিতে তারা বলেন— ২৯ বছর আগে জাতীয় জীবনের সবক্ষেত্রে বাংলা চালুর দাবিতে যে বীর শহীদরা জীবন দান করেছিলেন এবং যার পথ ধরে লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা, সেই অমর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের উপায় হচ্ছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা।