মুজিব বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণের সময় যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু

১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পত্রিকা‘স্বাধীনতার জন্য আমি আপনাদের ডাক দিয়েছিলাম, আপনাদের আমি দিতে চেয়েছিলাম আমার শুভেচ্ছা, আমার আদর্শ আর এক নীতি- যার ওপর ভিত্তি করে আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানের পাষণ্ড সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করেছেন। আপনাদের কাছে কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি জানি, যে জাতি সংঘবদ্ধ হয়, মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়,  সে জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না।’ ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি মুজিব বাহিনীর অস্ত্র সমর্পণের অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু এসব কথা বলেন। সেদিন স্টেডিয়ামে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাংলা’, ‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ’, ‘মুজিববাদ জিন্দাবাদ’, ‘মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করুন’ স্লোগানে ভরে ওঠে চারপাশ। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে আবেগঘন ও দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন।

এই অনুষ্ঠানে মুজিব বাহিনীর পক্ষে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ এমসিএ, আবদুল মান্নান অস্ত্র জমা দেন।১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পত্রিকা

প্রাণঢালা ভালবাসা নিয়ে বঙ্গবন্ধু

দেশ পুনর্গঠনে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে মুক্তিসেনাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের যুবকরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তাতে বাংলাদেশ জাতি সারা দুনিয়ায় চিরকাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে কিছুই ছিল না। কিন্তু আমি জানি, যে জাতি সংঘবদ্ধ হয়, মুক্তির জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেয়,  সে জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘কিন্তু আজ আপনাদের দেবার মতো আমার কিছুই নেই। আছে শুধু প্রাণঢালা ভালোবাসা। সে প্রাণঢালা ভালোবাসাই আজ আপনাদের দিচ্ছি। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। কিন্তু এর জন্য অত্যন্ত বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য এত রক্ত বিশ্ব ইতিহাসে কেউ দেয়নি। মানুষ যে এত পাষণ্ড, নীচ হতে পারে তা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেখিয়েছে। তারা অগনিত গ্রাম পুড়িয়েছে, লক্ষ লক্ষ মা বোনকে হত্যা করেছে। এসব কথা চিন্তা করলেও আমার গা শিউরে ওঠে।’১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পত্রিকা

ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে

৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্টেডিয়ামে অস্ত্র জমাদানের এই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে কোনও শক্তি সেটাতে ফাটল ধরাতে পারবে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ও তাদের জনগণের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। আজকের দিনে আমি যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, সেনাবাহিনী, পশ্চিম বাংলা, আসাম মেঘালয়ের জনগণকে ধন্যবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। তারা আমাদের এক কোটি লোককে খাবার ও স্থান দিয়েছে। আমাদের দুদেশের সম্পর্কে ফাটল ধরাতে বিদেশিরা চেষ্টা করছে। কিন্তু জনগণকে ধোঁকা দেওয়া যাবে না।’১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পত্রিকা

‘আমি আমেরিকাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি না’

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনা ঘাঁটি রাখতে সাম্র্রাজ্যবাদীরা ষড়যন্ত্র করছে। আমাদের সেনাবাহিনী, মুজিববাহিনী ও গণবাহিনী যখন এগিয়ে আসছিল, তার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সেনারা যখন এগিয়ে আসছিলেন, তখন সাম্রাজ্যবাদীরা চেষ্টা করেছে যাতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাদের ঘাঁটি থাকে। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার ভেটোতে তা সম্ভব হয়নি। আমি ধন্যবাদ জানাই গ্রেট বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এমনকি আমেরিকার জনগণ ও তাদের নেতাদেরও। কিন্তু আমি আমেরিকাকে ধন্যবাদ জানাতে পারি না। কারণ তারা জানতো, তাদের কাছে খবর ছিল বাংলাদেশে কীভাবে মানুষ মারা হচ্ছিল। তারা জানতো গ্রামকে গ্রাম ছারখার করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে আমেরিকার নিক্সন সরকার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে অস্ত্র দিয়েছে আমার মা বোনকে হত্যা করতে। কিন্তু আমেরিকার জনগণের কাছে, সাংবাদিক ও কেনেডির কাছে শুভেচ্ছা বাণী পৌঁছে দিতে চাই। বাংলার জনগণ কোনও মানুষের বিরুদ্ধে না, জালেমের বিরুদ্ধে। তা সে জালেম যেখানেই পয়দা হোক না কেন।’১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পত্রিকা

স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে

জাতির জনক বলেন, ‘স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের সাত কোটি জনগণ গুণে গুণে জীবন দান করবে, তবু স্বাধীনতা বিসর্জন দেবে না। রক্তের মূল্যে অর্জিত স্বাধীনতা আমরা প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করবো।’ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সতর্ক থাকতে হবে।’

সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য গণবাহিনীর প্রতি আকুল আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘নতুন করে সোনার বাংলা গড়ে তুলতে গণবাহিনীকে এখন জাতি পুনর্গঠনে লেগে পড়তে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের সঙ্গে হাল চাষ ধরতে হবে।’ ষড়যন্ত্রের কথা আবারও উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলার জনগণকে জানে না। আমাদের মুক্তিবাহিনী, গণবাহিনীকে জানে না। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নসাৎ করতে আমি আজ যে অস্ত্র নিচ্ছি প্রয়োজনে আবার আপনাদের হাতে তা তুলে দেবো।’১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পত্রিকা

বিশ্বব্যংক মিশনের সাক্ষাৎ

এই দিনে বিশ্ব ব্যাংক মিশনের প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। প্রথম সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু সহাস্যে বলেন, ‘আপনি একটি স্বাধীন দেশে আগমন করেছেন।’ বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা বলেন, ‘আমি তা জানি, আমি সেটা অনুভব করেছি।’ প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যর প্রতিনিধি দল ঢাকা এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকা কারগিলকে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনার সেই রিপোর্টের কথা আমি জানি।’ মি. ম্যাকনামারা ও কারগিল পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। কারগিলের সেই রিপোর্ট ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ম্যাকনামারার আপ্রাণ চেষ্টার কথা যে বঙ্গবন্ধু ভালো করেই জানেন ম্যাকনামারা সম্ভবত সেটা নিশ্চিত হন তখনই। বৈঠকের পর সরকারি মুখপাত্র জানান, বঙ্গবন্ধু বৈঠককে ‘অত্যন্ত সন্তোষজনক’ বলে উল্লেখ করেন। যদিও দুটি পৃথক বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সব প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।’১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারির পত্রিকা

পাকিস্তানের নেওয়া ঋণ প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু

পাকিস্তান বিদেশ থেকে যেসব ঋণ নিয়েছে তাতে বাংরাদেশের কোনও দায় নেই বলে সাফ জানিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পকিস্তান নানা সময়ে বিদেশি ঋণ নিয়েছে। কিন্তু তার থেকে বাংলাদেশে খুবই সামান্য ব্যয় হয়ে থাকতে পারে।’ রবার্ট ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী দ্বারা বাংলাদেশে ঘটা ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন- প্রয়োজনে ফেরত দেওয়ার কথা বলে অস্ত্র জমা নেন বঙ্গবন্ধু