বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ প্রথবারের মতো শহীদদের স্মরণ করবেন। ভাষার জন্য সংগ্রামকে যথাযথ মর্যাদা দেবেন। দেশে শোষণমুক্ত সমাজ গঠিত না হলে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কোনও অর্থ থাকবে না।’ তার সেদিনের ভাষণটি ছিল বিশেষভাবে স্মরণীয়।
একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো শহীদ দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। ১৯৪৭ সালের ১১ মার্চ থেকে সংগ্রাম শুরু হয়। সেদিন আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, শুধু ভাষা আন্দোলন ছিল না এবং কেবলমাত্র ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুরু হয়নি। এ আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলন। ১৯৪০ সাল থেকে ধীরে ধীরে এ সংগ্রাম শুরু হয় ’৫২ সালে গিয়ে সেই সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। সেদিন আমাদের দেশের ছেলেরা রক্ত দিয়েছিল, শহীদ হয়েছিল বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। কিন্তু সেটা কী শুধু ভাষা আন্দোলন ছিল? অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেনি যে বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে। বাংলার মানুষকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল চরম সংগ্রামের প্রস্তুতি।’
স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার
বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেন, ‘শাসকগোষ্ঠী আমার ভাই-বোনদের আঘাত করেছে, আমাদের সংস্কৃতির ও অর্থনীতির ওপর আঘাত করে ভিখারি করেছে বাংলার জনগণকে। কিন্তু বাঙালি এমন এক জাতি যারা রক্ত দিতে জানে। সে জাতিকে কেউ রুখতে পারে না। শাসকগোষ্ঠী এটা বুঝে তাদের সব শক্তি দিয়ে আক্রমণ করেছিল।’
জাতির পিতা বলেন, ‘আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য, কিন্তু তাও অনেক রক্তের বিনিময়ে। আমাদের এ রক্ত বৃথা যাবে, এ স্বাধীনতা বৃথা যাবে, যদি এদেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি। যদি দেশের মানুষকে শোষণ মুক্ত করতে না পারি। শোষণ মুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। তা যদি করতে হয় তাহলে এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে।’
দরকার শপথ নেওয়া
বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এবারে শপথ নেবে। আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবো না যদি শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। আমাদের স্বাধীনতা আমরা এনেছি, যদি প্রয়োজন হয় রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করবো। যারা শহীদ হয়েছেন, যেসব মায়ের বুক খালি হয়েছে, যিনি বিধবা হয়েছেন, কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা হয়েছে, তাদের কথা স্মরণ করে শপথ নিতে হবে- বাংলার মাটিতে শোষনহীন সমাজ গঠনের। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করতে হবে। মানুষ যাতে আর কষ্ট না পায়, আর কোনোদিন অত্যাচারিত, নিপীড়িত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমি অনুরোধ করছি বিশেষভাবে যুবসমাজ, ছাত্রসমাজ, কৃষক-শ্রমিক ভাইদের সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে।’
নির্বাচন ১৯৭৩ এর মার্চে
১৯৭৩ সালের মার্চ নাগাদ আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে বলে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ব্যাপারে দেশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা নীতিগতভাবে মতৈক্যে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশের আবহাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এদেশে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপযুক্ত সময় বিবেচিত হয়।
এদিকে গণপরিষদের অধিবেশনে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর আদমশুমারি শুরু হলে নির্বাচনি এলাকা গঠনে বেশ কয়েক মাস সময় চলে যাবে। সেজন্য পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চের দিকে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
প্রথম পল্লি সফরে বঙ্গবন্ধু
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ২০ তারিখ নোয়াখালী যাবেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জেলার রামগতিতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের সূচনা করবেন তিনি। নিজ হাতে মাটি কেটে বাঁধ নির্মাণে উৎসাহ দেবেন বঙ্গবন্ধু। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটি হবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম পল্লি অঞ্চল সফর। এর আগে তিনি মুক্তি বাহিনীর কাছ থেকে হতে অস্ত্র গ্রহণের উদ্দেশে টাঙ্গাইলে গিয়েছিলেন। কিন্তু জাতিগঠন কাজে পল্লির জনগণের মাঝে এটাই হবে তার প্রথম যাওয়া। বঙ্গবন্ধুকে সেখানে দেখতে অনেকে হাজির হবেন। সবাই একটি কোদাল ও মাটি রাখার ঝুড়ি সঙ্গে নিয়ে যাবেন। ফুলের মালার বদলে এভাবেই জনগণ বঙ্গবন্ধুকে সম্মাননা জানাবে।
স্মৃতির মিনারের জায়গা নির্ধারণ
ইডেন ভবনের দক্ষিণে অবস্থিত রেলওয়ে কলোনির বিস্তীর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতির মিনার গড়ে তোলার প্রস্তাব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিবেচনা করছেন বলে প্রকাশ করা হয়। প্রায় আড়াইশ বিঘা জমির ওপর এই সৌধ নির্মাণ করা হবে। এককালে ঢাকার নবাবদের বাগানবাড়ির এটি একটি অংশ ছিল। ১১ দফা গণআন্দোলনে এলাকাটি বিশিষ্টতা লাভ করে। গণঅভ্যুত্থানের মিছিলের ওপর গুলি চালানো হয়, বুলেটের আঘাতে এখানে সংগ্রামী শ্রমিক রক্তরঞ্জিত হয়। আর সেই শার্টের রক্ত পতাকা মিছিলে মিছিলে আগুন ছড়ায়।
আরও পড়ুন:
কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক, বাংলাদেশ টিকে থাকবে: বঙ্গবন্ধু