ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়ে বঙ্গবন্ধু নতুন করে যা ভাবছিলেন

১১১ঢাকার অদূরে টঙ্গী শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নামে সৃষ্ট অরাজকতা নিয়ে নতুন করে হুঁশিয়ারি দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা দেখা করতে গেলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, নতুন নির্বাচন হবে গোপন ব্যালটে। তিনি এও বলেন, সরকার কোনও গুণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেবে না। এদিকে সে সময় ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অভ্যর্থনা জানানোর জোর প্রস্তুতি চলছিল। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দু’দিনের সফরে ঢাকায় আসা উপলক্ষে এ প্রস্তুতি চলে। একই সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কোন আইনে কোন পথে হবে তা নিয়ে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিসরে চলছিল নানা আলোচনা।

ভোট হবে গোপন ব্যালটে

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানান যে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে দেশের ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাসসের খবরে প্রকাশ, ১৯৭২-এর ৮ মার্চ বাংলাদেশের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই শুধু ট্রেড ইউনিয়নগুলোতে প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হবে। এদিন বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফেডারেশনের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাধারণ সম্পাদক হায়দার আকবর খান রনো, বাংলাদেশ শ্রমিক সমিতির কেন্দ্রীয় সংগঠক রাশেদ খান মেনন বঙ্গবন্ধুকে সাম্প্রতিক শ্রমিক সহিংসতার বিষয়ে অবহিত করেন।

রনো প্রধানমন্ত্রীকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটছে তা ট্রেড ইউনিয়নের সমস্যা বা স্থানীয় বিরোধ নয়। মূলত ট্রেড ইউনিয়ন-বহির্ভূত কিছু লোক স্বাধীনতা-উত্তরকালীন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অরাজকতা তৈরি করেছে। ফেডারেশনের ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ট্রেড ইউনিয়ন আইনসঙ্গত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ‘বার্গেনিং এজেন্ট' হিসেবে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে ২৫ মার্চের আগেই স্বীকার করা, সরকারি তদারকিতে গোপন ব্যালটে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর সহযোগিতায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার প্রস্তাব দেন।

বঙ্গবন্ধুর শ্রমিক নেতাদের বলেন, শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই কেবল তাদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন। তিনি বলেন, টঙ্গী অঞ্চলে অবিলম্বে সব গুণ্ডামি, হয়রানি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

২২২২

ঢাকায় আসছেন ইন্দিরা গান্ধী

ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীকে এক ঐতিহাসিক সংবর্ধনা জ্ঞাপনের জোর প্রস্তুতি ছিল মার্চের শুরু থেকেই। এদিনের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এর অগ্রগতি বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। দৈনিক বাংলার এ সংক্রান্ত তিন কলাম প্রতিবেদনে তাকে বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু অভিহিত করে তার ভাষণের জন্য রেসকোর্স ময়দান তৈরি করার বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়: বাংলাদেশের মানুষের ওপর বর্বর হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসবেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সফরে প্রথম সুযোগেই তিনি এসে দাঁড়াবেন এ দেশের আপামর জনতার সামনে, এসে দাঁড়াবেন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের জনসভায়। ভাষণ দেবেন জনতার উদ্দেশে।

 

নবচটআরেসকোর্সের আয়োজন

দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, রেসকোর্সে শ্রীমতি গান্ধীর জনসভার জন্য একটি স্থায়ী মঞ্চ নির্মাণের কাজ চলছিল। এ মঞ্চের উচ্চতা হবে ২০ ফুট। তারও ১৩ ফুট ওপরে থাকবে ছাদ। মঞ্চের সামনের অংশে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি ব্যালকনি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধী জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। নৌকা আকৃতির এ মঞ্চের দৈর্ঘ্য হবে ৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ২০ ফুট। জনসভাকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে পুরো রেসকোর্সকে ১৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সামনের দিকে থাকবে প্রায় ২০ হাজার নারীর বসার জায়গা।

ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্ক কী হবে?

দৈনিক বাংলার প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নিয়মিত ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য কোনও কার্যকর ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে এই দুই দেশের মধ্যে স্বাভাবিক পন্থায় বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে না এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন দেশের ব্যবসায়ীরা। এ পরিস্থিতিতে প্রথমদিকে দেশটির সঙ্গে যে পরিমিত পরিমাণ চোরাচালান আদান-প্রদান হতো, ক্রমশ তার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ব্যবসায়ী মহলের মতে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাভাবিক বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে না ওঠায় একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিনাশুল্কে কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি-রফতানি করছেন। চোরাচালান বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মত দেয় ব্যবসায়ী মহল এবং ইন্দিরা গান্ধীর সফর উপলক্ষে এ বিষয়ে একটি চুক্তির বিষয়েও আলাপ শুরু হয়েছে বলে ৯ মার্চ  প্রকাশিত পত্রিকাটির প্রতিবেদনে জানানো হয়।   

Untitledযুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে

একটি জাতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ন্যায্য অধিকার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রয়েছে। যুগোস্লাভ আইনজ্ঞ অ্যালেস বেবলার ঢাকায় এসে এদিন এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন। আন্তর্জাতিক আইনবিদ পরিষদ এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে তিনি বলেন, ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালানো হয়েছে যে দেশে সে দেশের সরকার যদি সেই গণহত্যার জন্য দায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে তবে সে ব্যাপারে কারোরই কিছু বলার নেই। তিনি বলেন, জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার নিজেরাই জাতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠন করে যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারেন। তিনি বাংলাদেশের আইন ও পার্লামেন্টারি বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের কাছে এ বিষয়ে সুপারিশ করেছেন বলে জানান। যুগোস্লাভিয়ার এই আইনজীবী ছিলেন গণহত্যা বিষয়ক জেনেভা কনভেনশনের অন্যতম প্রণেতা। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় অ্যালেস বেবলার মন্তব্য করেন, যদি যুদ্ধাপরাধের বিচার না করা হয় তবে আর এই কনভেনশনের প্রয়োজন কী? আন্তর্জাতিক আইনবিদ পরিষদ আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুগোস্লাভরা নিজেরাই জার্মানদের যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছিল। তাদের কোনও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজন হয়নি।

ছাত্রলীগ ও ডাকসুর যুক্ত বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচিকে সমর্থন

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে ছাত্রনেতারা একাত্মতা ঘোষণা করেন। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ ঘোষণা করে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা  করেছেন আমরা তাতে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করছি। এদিকে, ৭ মার্চের পরের দিনেই চিত্র বদলে যেতে শুরু করে। অস্থানীয়দের ঢাকা ত্যাগের হিড়িকের খবর আসে পত্রিকাজুড়ে। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের দেশত্যাগের জন্য কোনও বিমান টিকিট দেওয়া হচ্ছে না বলেও খবর প্রকাশ হয়।