দেশে গোলযোগ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের সতর্ক করে বঙ্গবন্ধু বলেন, গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের জনগণ সহ্য করবে না। গোলযোগ সৃষ্টিকারীরা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি ভ্রান্ত বলে আখ্যায়িত করছে। এ সম্পর্কে দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান লিখছে। আমি পুলিশকে আদেশ দিচ্ছি এসব নকশালবাড়িওয়ালাদের যেখানে পাবেন সেখানেই গুলি করুন। গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের আটকে প্রশাসনকে সাহায্য করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু।
শৃঙ্খলা বজায় রাখুন
যেকোনও মূল্যে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, শৃঙ্খলা ছাড়া কেউ সমৃদ্ধি লাভ করতে পারে না। শৃঙ্খলার ওপর ভিত্তি করে আগে সমাজকে গড়ে তুলতে হবে।
ধর্মঘট ও ঘেরাও থেকে বিরত থাকতে বঙ্গবন্ধু শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, নতুন জাতি শূন্য হাতে ভবিষ্যতের পথে যাত্রা শুরু করেছে। বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। কিন্তু তাই বলে আমরা ঘুমিয়ে নেই। জাতীয়করণ সম্পর্কিত ঘোষণা প্রদান করা হয়েছে। জনগণের কল্যাণের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করাও হচ্ছে। শিগগিরই শ্রমিকদের মিল-কারখানা পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে। কাজেই আপনারা আপনাদের দাবি-দাওয়া আর ঘেরাও সম্পর্কে সতর্ক হোন। কল-কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করা হচ্ছে। এসব পরিচালনায় শ্রমিকদের নিজস্ব প্রতিনিধি থাকবে।
মুনাফার অংশ শ্রমিক পাবে
মুনাফার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে জানিয়ে শ্রমিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, অতএব এ ব্যবস্থায় আপনারা কোনও প্রকার ধর্মঘটের আশ্রয় নেবেন না, এই মর্মে আপনাদের সুস্পষ্টভাবে ওয়াদা করতে হবে। কোনও রকম দাবি-দাওয়া পেশ না করে তিন বছরের জন্য শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রম করে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় ও অস্থানীয় শ্রমিকদের মধ্যে কোনও ব্যবধান না করার জন্য তিনি শ্রমিকদের বিশেষভাবে বলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতীয় কর্মসূচি মোতাবেক সমস্ত সম্পত্তির মালিক হচ্ছে জনগণ আর জনগণের সবাই, শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ থাকুন—এটাই আমি চাই। আপনারা যদি কঠোর পরিশ্রম করেন তাহলে আপনাদের জীবন হবে সুখ ও শান্তিপূর্ণ, এই আশ্বাস আমি আপনাদের দিতে পারি।
ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা
বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণের জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে ত্রিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে আর এক কোটি মানুষকে বাধ্য করেছে দেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নিতে—এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের জনগণ ও ভারত সরকার বিভিন্ন ব্যক্তিদের আশ্রয় দিয়েছেন। আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী আর ভারতের জনগণকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছি না।
ভুট্টোর লজ্জিত হওয়া উচিত
বঙ্গবন্ধু বলেন, বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আচরণে ভুট্টোর লজ্জিত হওয়া উচিত। যুদ্ধবন্দিদের সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই বলে ঘোষণা করা উচিত। পাকিস্তানি সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু বলেন, তোমাদের ভালো কপাল যে পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের পাশে অবস্থিত নয়। যদি তাই হতো তাহলে বাঙালিরা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সে অংশটা জয় করে নিতো। তিনি বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী তাদের জঘন্য কাজে সাথে পেয়েছে রাজাকার-আলবদর ও জামাতিদের। এরা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এসব দালালের পক্ষে যদি কেউ কোনও কথা বলতে আসে তাহলে সেও তার সমতুল্য অপরাধ করবে। এই দালালদের কখনও ক্ষমা করা হবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের করা কতিপয় মন্তব্যের উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, জনাব ভুট্টো বলেছেন, বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর মানুষরূপী পশুদের বিচার হতে নাকি তিনি দেবেন না, কিন্তু আমি তাকে জানিয়ে দিচ্ছি, বাংলাদেশের মাটিতেই অসুরের বিচার হবে এবং তা হবেই।
বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের নাগালের বাইরে রাখার জন্যই পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দিদের ভারতে পাঠানো হয়েছে। অন্যথায় জনগণ তাদের হত্যা করতো। এদের বিচার হবেই এবং দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে।
ঘুষ খাবেন না
সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, গণবিরোধী তৎপরতায় আপনারা যাবেন না। কারো কাছ থেকে ঘুষ খাবেন না। একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ না দিতে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। কোনও কোনও দেশ যে শর্তযুক্ত ত্রাণ দিতে চাচ্ছে, সে কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, শর্তসাপেক্ষে সহায়তা নিলে দেশকে টাকার বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু এই শর্তপূর্ণ ঋণ আমি নেবো না। কেননা, তাহলে আমার জনগণ দাসে পরিণত হবে এবং ভবিষ্যত বংশধরেরা দুর্দশাগ্রস্ত হবে। সাহায্যসামগ্রী সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের জন্য তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও এমসিএদের প্রতি নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে জনগণকেও সতর্ক থাকতে বলেন বঙ্গবন্ধু।