নিঃস্বার্থভাবে জনসেবায় এগিয়ে আসুন: কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু

1জনগণের আস্থা অর্জনে নিঃস্বার্থভাবে জনসেবায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিলের বক্তৃতায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘জনসেবার মধ্যদিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে।’

১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত দুদিনব্যাপী কাউন্সিলে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘গণপরিষদের সদস্য ও দলীয় কর্মীরা যদি জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে কাজ না করে, তাহলে দল ভেঙে পড়বে।’

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল শুরু হয় কাকরাইলে ওইদিন বিকাল তিনটায়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে দলের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদ বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠ করেন। এরপর পার্টির প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তব্য রাখেন।

কাউন্সিলররা বিশেষ রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে দলের প্রধান হিসেবে ধারাবাহিকতা রক্ষার অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু যেন পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার দায়িত্ব অব্যাহত রাখেন এবং দলের জন্য এই মুহূর্তে সেটি জরুরি বলেও কাউন্সিলরদের মধ্যে তাঁর শক্ত অবস্থান ছিল।

বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় প্রধানত দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে আলোকপাত করেন। সরকারের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বলেন, ‘তার দল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং এ কারণে তার সরকার ইতোমধ্যে ব্যাংক ও ইন্সুরেন্সসহ বড় শিল্পকে জাতীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে কর্মীদের জানিয়ে দেন যে, কোনও ধনীকে আরও ধনী হতে দেওয়া যাবে না। একক ব্যক্তির হাতে একশ’ বিঘার বেশি জমি থাকবে না।’ তিনি এও বলেন, ‘পরবর্তীতে এই একশ’ বিঘা পরিমাণে আরও  কমবে।’

33বৈদেশিক নীতির বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বলেন, ‘সরকারি বৈদেশিক নীতি হলো— সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ এরপর তিনি পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ের সমঝোতা নিয়ে কথা বলেন।

চীন যেভাবে পাকিস্তানের ধ্বংসযজ্ঞকে সমর্থন দিয়েছে তাতে বঙ্গবন্ধু স্তম্ভিত হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চীন এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের মতো তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে।’ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যদের মধ্যে চার সদস্য বাংলাদেশকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এ বিশ্ব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।’

এসময় উৎফুল্ল স্লোগানমুখর কাউন্সিলরদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যতদিন সভ্যতার অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন বাংলাদেশ তার পতাকা এবং জাতীয় সংগীত নিয়ে টিকে থাকবে। বাংলাদেশ টিকে থাকার জন্য জন্ম নিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের আর বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না। তারা দ্রুতই বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবেন। যুদ্ধাপরাধীরা কোনোভাবেই শাস্তির বাইরে থাকবে না।’ তবে তাকে মুক্ত করার জন্য তিনি ভুট্টোর প্রতি তার ব্যক্তিগত ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি জহুর আহমেদ চৌধুরীকে তার স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রচারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি তাকে বলেছিলাম, এটা সম্ভবত শেষ বার্তা এবং দলীয় কর্মীদের কাছে শেষ আহ্বান।’ তারা তাদের দায়িত্ব অনুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে বলে বঙ্গবন্ধু আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিসংগ্রাম ছিনিয়ে আনবে। কারণ, তারা জানে কীভাবে লড়াই করতে হয়।

দলের কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন যে, ‘আমি খুব ব্যথিত হয়েছি যখন জানতে পেরেছি যে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মীরা পরস্পরের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়িতে যুক্ত হয়েছে। আত্মসমালোচনা ভালো, কিন্তু অন্যের প্রতি আক্রমণাত্মক হওয়া ঠিক নয়।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যেসব সদস্য দুর্নীতির সঙ্গে জড়াবে, তাদের প্রত্যেককে বহিষ্কার করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় সদস্যদের ভাগ্য দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের মতোই হবে।’

ষড়যন্ত্রকারীদের প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জানি, আওয়ামী লীগের কর্মীদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল এবং তারা সব কিছু হারিয়েছে। ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত আছে।’ তিনি বলেন, ‘এখানে যেমন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে, তেমনই এখানে ষড়যন্ত্রকারীরাও রয়েছে।’ যারা আল-বদর রাজাকারদের সঙ্গে নানা সময়ে সহযোগিতা করেছে, বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই তাদের বিষয়ে বার বার সতর্কতা ব্যক্ত করে আসছিলেন।