সেবারের নববর্ষ ছিল রক্তস্নাত। ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে দেশের সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি জাতিকে পুনর্গঠনের যাবতীয় প্রক্রিয়া তখন চলমান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতি, ধর্ম ও রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সবার প্রতি বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করা দৃঢ় শপথ গ্রহণের আহ্বান জানান।
এদিনের দৈনিক বাংলা ও ডেইলি অবজারভারে প্রকাশিত সংবাদগুলো থেকে জানা যায়, ঢাকায় সে বছর নববর্ষ উদযাপন করা হয় বিপুল উৎসাহ আর প্রাণপ্রাচুর্যের মধ্য দিয়ে। শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, আলোচনা সভা, সেমিনার, নৃত্যগীত আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বরণ করা হয় নববর্ষকে। এছাড়া, মসজিদ ও গির্জায় বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনায় কল্যাণ কামনা করা হয় দেশ ও জাতির।
নববর্ষ উপলক্ষে শহরের সব শ্রেণির নাগরিক গিয়েছিল বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শুভেচ্ছা জানাতে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন পহেলা বৈশাখের সুপ্রভাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে সেবার বাংলা নববর্ষ আসে নতুন রূপে। বাংলার মানুষ তাই সাদর আহ্বান জানায়। এদিন বাংলা অ্যাকাডেমি নববর্ষ উপলক্ষে বিচিত্রা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।
বঙ্গবন্ধু বাণীতে বলেন, ‘১৩৭৮ সনের দুঃখ-দুর্দশা আর ত্যাগ-তিতিক্ষা পেরিয়ে নতুন বছর ১৩৭৯ সনের সূচনা। মহাকালের গর্ভে বিলীন হলো আরেকটি বছর। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিগত বছরটি অবিস্মরণীয় ও চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। এই বছরে ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে সাড়ে সাত কোটি মানুষের পাশে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।’
তিনি বলেন, ‘সুদীর্ঘ ২৫ বছরের দুঃখ-দুর্দশা সংগ্রাম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার পর এই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রক্তিম লাল ও সবুজ পতাকা উড়ছে আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। তাই আসুন, সবাই এই পতাকার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখবার উদ্দেশ্যে লাখো শহীদের আত্মার নামে শপথ করে দেশ গড়ার কাজে নিজেদের উৎসর্গ করি।’ তিনি বাণীতে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সার্বিক উন্নতি সাধন করতে হলে সরকারের প্রতিটি নীতির বাস্তবায়ন অপরিহার্য। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
বাংলা নববর্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ এক বিবৃতিতে বাংলা ভাষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেন। বিবৃতিতে বলা হয়, মুখের ভাষার জন্য এই ভাগ্য বিড়ম্বিত বাংলার মানুষকে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করতে অর্ঘ্য দিতে হয়েছে জীবন। কিন্তু আজও বাংলা ভাষার তীব্র মর্যাদার আসন জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। গ্রামীণ মানুষের জীবন পরতে পরতে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে, শহুরে জীবনের শ্বাসরুদ্ধ আবহাওয়ায় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। নির্দলীয় বাংলার শ্যামল মাটিকে ভালবেসে গ্রামীণ মানুষের হৃদয়ের অনুভূতিকে উপলব্ধি করে আজ বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যায়ন করতে পারলেই বাংলাদেশের আসনে সে তার মর্যাদা লাভ করবে।