বাকিদের জন্য বিমা ও প্রণোদনা, গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য শুধুই ‘ধন্যবাদ’

 বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকতে সবাইকে ঘরে বসে নববর্ষ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর জন্য বিমা ও প্রণোদনার কথা জানালেও ঝুঁকির মধ্যে তথ্যসেবা দিয়ে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মীদের কেবল ধন্যবাদ দিয়েছেন।  যদিও কিছুদিন আাগে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গণমাধ্যম মালিকদের প্রতিনিধি দল বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রণোদনা দিয়ে গণমাধ্যমকে সহায়তার দাবি জানিয়েছিলেন। সাংবাদিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, গণমাধ্যম কখনোই ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য কাজ করে না। তবে বিরূপ পরিস্থিতিতে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাজ থেকে ধন্যবাদের পাশাপাশি প্রণোদনা আশা করেছিলেন। তারা বলছেন, যখন কিনা আইনশৃঙ্খলাবাহিনী চিকিৎসক নার্সদের মতো সাংবাদিকরাও নিরলস তথ্য সেবা দিচ্ছে, ঝুঁকি নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে কাজ করছে তখন তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী কোনও প্রস্তাবনা রাখলে সেটি উৎসাহব্যঞ্জক হতো।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে যারা চিকিৎসাসেবা দেওয়াসহ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আছেন তাদের জন্য বিমার ঘোষণা দেন। এছাড়াও এর আগে ব্যবসায়ী থেকে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার প্রণোদনা বাজেট ঘোষণা করেছেন তারও উল্লেখ করেন। তবে এই ভাষণে মিডিয়াকর্মীদের জন্য ছিল শুধুই ‘ধন্যবাদ’। করোনাভাইরাসের সব খবর প্রচার ঝুঁকি নিয়ে প্রচার করলেও এখনও সংবাদকর্মীদের জন্য কোনও প্রণোদনা বা বিমার ঘোষণা দেননি প্রধানমন্ত্রী।

চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের অভয় দিয়ে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দায়িত্ব পালনকালে যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবিমা, মৃত্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে। তিনি জানান, স্বাস্থ্যবিমা ও জীবনবিমা বাবদ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৭৫০ কোটি টাকা।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গে সাংবাদিকদেরও ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন,‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে নিয়োজিত পুলিশ-সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা, মিডিয়া কর্মী, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী আনা-নেওয়ার কাজে এবং মৃত ব্যক্তির দাফন ও সৎকারের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মীগণসহ জরুরি সেবা কাজে যাঁরা নিয়োজিত রয়েছেন, তাঁদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’

এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি অনুরোধ করেছেন, ‘দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক তথ্য তুলে ধরে এই মহামারি মোকাবিলা করতে আমাদের সহায়তা করুন।’

নববর্ষ পালনের এই ভাষণে এর বাইরে গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়ে আর কোনও কথা বলেননি প্রধানমন্ত্রী। এর আগে গত ৫ এপ্রিল যে বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন তিনি তাতে সমাজের সব স্তরের পেশাজীবীদের বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দেওয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হলেও কোথাও গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য কোনও প্যাকেজের বা প্রণোদনার কথা উল্লেখ করা হয়নি।

অথচ করোনার এই ঝুঁকির ভেতরেই সংবাদকর্মীরা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নিয়মিত মাঠে ও অফিসে কাজ করছেন এবং পেশাগত কাজের কারণেই এরইমধ্যে ৬ জন সংবাদকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাজ সামলাতে গিয়েই হোম কোয়ারেন্টিনে যেতে হয়েছে।

সাংবাদিকরা কখনোই ধন্যবাদ পাওয়ার জন্য কাজ করে না উল্লেখ করে বর্তমানে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকা ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে কোনও দুর্যোগে সাংবাদিকরা ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করে। তাদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা আরও ভয়াবহ ঝুঁকিতে রয়েছেন। কেননা কয়েকটি মিডিয়া হাউস ছাড়া বেশিরভাগই বকেয়া বেতনের মধ্যে পড়েছে।’

এর কারণ বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একদিকে বিজ্ঞাপনদাতারা দেনা শোধ করতে পারছে না, আরেকদিকে সংবাদপত্র বাসায় পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে এইসময় সরকার গণমাধ্যম বা এর মালিকদের জন্য বিনা সুদে বা কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে পারতেন কিনা তা বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

ঋণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, যদি সরকার সংবাদ-কর্মীদের সহায়তা করতেই চান তাহলে সেটি সাংবাদিক কর্মচারীদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি দিতে হবে। পরবর্তীতে মালিক সেই টাকা স্বল্পসুদে সরকারকে ফেরত দিতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের ধন্যবাদ দিয়ে তাদের কাজের মূল্যায়ন করেছেন উল্লেখ করে সাংবাদিক নেতা সোহেল হায়দার চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তবে ধন্যবাদের পাশাপাশি এখন নিরাপত্তা, বকেয়া বেতনসহ যেসব সংকটের মধ্যে সাংবাদিকরা রয়েছেন সেখানে তাদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পুরস্কারও পাওয়া উচিত।

সাংবাদিকরা সংকটের সময়ে একাত্ম হয়ে কাজ করেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সেবাদানকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও কর্মচারী যখন স্বাস্থ্যবিমাসহ নানাভাবে পুরস্কৃত হচ্ছেন সেই জায়গায় স্বচ্ছ তালিকা তৈরি করে সাংবাদিকদের প্রত্যেকের হাতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে পুরস্কার আসা উচিত। যাতে করে কিছুদিন তারা পরিবারের সঙ্গে স্বস্তি নিয়ে চলতে পারেন।

কিছু প্রতিষ্ঠান বাদে বেশিরভাগ সাংবাদিকের সময়মতো বেতনভাতা পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, ‘সামনে রোজার ঈদ আছে। প্রধানমন্ত্রী তার তহবিল থেকে পেশাজীবী সাংবাদিকদের যৌক্তিক তালিকা করে থোক বরাদ্দ দিতে পারেন। এবং লক্ষ্য রাখতে হবে প্রকৃত সাংবাদিকরাই যেন সেটি পান।’

তিনি বলেন, ‘আমি এও মনে করি রাষ্ট্রের যে সৈনিকেরা সব ভয়কে জয় করে মাঠে আছে তাদেরসহ সাংবাদিকদের জন্য এই আপদকালীন সময়ে রেশনিং এর ব্যবস্থা করা দরকার।’

প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের ধন্যবাদ দেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন গাজী টেলিভিশন (জিটিভি) ও সারাবাংলাডটনেট এর এডিটর-ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই বৈরী সময়েও সাংবাদিকদের কাজের মূল্যায়ন করে প্রধানমন্ত্রীর ধন্যবাদ দেওয়ায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে এসময় নানা যোদ্ধা যারা এই বিরূপ পরিস্থিতিতে কাজ করছেন তাদের প্রণোদনা দেওয়া জরুরি মনে করি। একইসঙ্গে সাংবাদিকদের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর নজরে থাকলে, তিনি যদি সেটি নিয়ে কিছু বলতেন আমরা খুশি হতাম। সাংবাদিকরা নিরলস তথ্যসেবা দিচ্ছেন, ঝুঁকি নিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে কাজ করছেন। ফলে তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী কোনও প্রস্তাবনা রাখলে সেটি উৎসাহব্যঞ্জক হতো।