দর্জিবাড়ির দুর্দিন

টেইলার্সমেশিনে অলস বসে আছেন। তাকিয়ে আছেন দোকানের দরজার দিকে। সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘চাচা আসেন, বসেন। কী সেলাই করবেন? জামা? নাকি পাঞ্জাবি? নাকি বাচ্চাদের জন্য...। অর্ডার দিলে কালই সেলাই করে দিয়ে দিতে পারবো।’ তবে উত্তর পেয়ে মুখটা মলিন হয়ে পড়ে দর্জি দিদার হাওলাদারের। জানতে পারেন যাকে নিয়ে তার এত আগ্রহ, তিনি গ্রাহক নন, একজন গণমাধ্যমকর্মী!

এই দিদার হাওলাদার রাজধানীর খিলগাঁও তিলপাপাড়া কাপড় গলিতে ১৫ বছর ধরে সেলাইয়ের কাজ করছেন। মৌসুমী টেইলার্সের মালিক তিনি। ব্যবসায় জীবনে অতীতে কখনও এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়নি তাকে।

বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বাজান এখন ব্যবসায়ী জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছি। অতীতে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। রমজানের ঈদের সময় ১৫ রমজান যাওয়ার পর আর কোনও অর্ডার নিতাম না। কারণ, যেসব অর্ডার তার আগে নেওয়া হতো সেগুলো সরবরাহ করতেই হিমশিম খেতে হতো। কাজের এমনই চাপ ছিল। আর এ বছর সেই চিত্র পুরোপুরি উল্টো। ঈদ ছাড়া বছরের অন্য সময়ের চেয়েও গ্রাহক অনেক কম।

ফাঁকা টেইলার্স

তিনি আরও বলেন, আমাদের দোকানের গ্রাহকদের মধ্যে সিংহভাগই নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত। অন্যান্য বছর এই সময়টাতে তাদের চাপে দম ফেলতে পারতাম না। কাজের এমন চাপ থাকতো। কিন্তু এ বছর মানুষই আসছে না। কারণ, এই শ্রেণির মানুষগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। তারা বাসা ভাড়া ও পরিবার চালাতে গিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। তাই ঈদের কেনাকাটায় কোনও বাড়তি চিন্তা নেই তাদের।

দিদার হাওলাদারের পাশে বসে ছিলেন গ্রাহক নাজমা আক্তার। তিনি বলেন, অন্যান্য বছর মামার (দিদার হাওলাদার) দোকান থেকে ছেলেমেয়ের জন্য পাঁচ থেকে ছয়টা জামা সেলাই করাতাম। তবে এ বছর শুধু ছোট্ট মেয়ের জন্য একটা জামা সেলাই করিয়েছি। নিজের জন্য আর কিছুই করিনি। হাতে কোনও টাকা-পয়সাও নেই। মানুষ এখন ঠিকমতো ভাত খেতে পারছে না, জামা-কাপড় বানাবে কীভাবে?

একটু সামনে এগিয়েই দেখা গেলো বাচ্চাদের ছোট্ট একটি প্যান্ট সেলাই করছেন ষাটোর্ধ্ব মাসুদুর রহমান। কাছে গেলে তিনিও জানালেন কষ্টের কথা। চরম হতাশা নিয়েই বসে আছেন সেলাই মেশিনে।

মাসুদুর রহমান বলেন, ‘এই সময় আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু সময়ও থাকার কথা ছিল না। কিন্তু এখন হাতে কোনও কাজ নেই। হাতের প্যান্টটি সেলাই করার পর আরেকটি কাজের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে। কাজ নেই বলে অনেক দেরি করে দোকান খুলেছি। কিন্তু এরপরেও মানুষ নেই। দোকানে বেচাবিক্রিও নেই। অথচ বছরে মাত্র দুটি ঈদের আয় দিয়েই বেশ কয়েক মাস চলে যেতো।’

টেইলার্সশনিবার (২৩ মে) নগরীর অলিগলির দর্জিবাড়িগুলোতে গিয়ে এমনই চিত্র দেখা গেছে। অধিকাংশ দর্জিরই কোনও কাজ নেই।

বলা চলে অনেকটা অলস সময়ই পার করছেন তারা। লাভের আশা না থাকলেও সবারই চিন্তা দোকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন ভাতা পরিশোধ নিয়ে।

জানতে চাইলে মাইশা টেইলার্সের মালিক বিলকিস বেগম বলেন, লাভের তো আশাই করছি না। চিন্তা হচ্ছে যে দুই জন সহযোগী রেখেছি, ঈদে তাদের মুখ উজ্জ্বল করবো কীভাবে। দোকান ভাড়া কোথা থেকে দেবো? দোকানে তো কোনও কাজ নেই। মানুষ আসছে না। এলেও অনেক দরকষাকষি করে। লাভই করা যায় না। এ অবস্থায় ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে খুবই কষ্ট করছেন বলে জানান তিনি।