সুন্দরবনে বাঘ স্থানান্তর করতে চায় বন বিভাগ

সুন্দরবনের বাঘ (ছবি: ইউএনবি)সুন্দরবনে বাঘের আনাগোনা কেমন তা ড্রোন উড়িয়ে মনিটরিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছে বন বিভাগ। তাদের দাবি, বনে বাঘের আনাগোনা বেড়েছে। মাঝে মধ্যে বনের বিভিন্ন অংশে বাঘের দেখা মিলছে। তবে বনের সব অংশে বাঘের সমান বিচরণ না থাকায় বাঘ স্থানান্তর করতে চায় বন বিভাগ।

বাঘকে নিরাপত্তা দিতে বন বিভাগ নানা পরিকল্পনা নিয়ে ‘বাঘ সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করেছে। এটি আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঘ রক্ষায় দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, গত ১০০ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন বনাঞ্চল থেকে বাঘের সংখ্যা এক লাখ থেকে কমে চার হাজারেরও নিচে দাঁড়িয়েছে। বাঘের আট উপ-প্রজাতির মধ্যে এরইমধ্যে তিনটি বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ মাত্র ১২টি দেশে বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে।

সারা বিশ্বে বন উজাড়, শিকারি ও পাচারকারীদের কারণে বাঘ মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়ায় বাঘের অস্তিত্ব রয়েছে। এরমধ্যে ভিয়েতনাম ও লাওসে বাঘ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। বাঘের আটটি উপ-প্রজাতির মধ্যে ইতোমধ্যে বালিনিজ টাইগার, জাভানিজ টাইগার ও কাম্পিয়ান টাইগার বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুসারে সুন্দরবনে বাঘ রক্ষার জন্য বন বিভাগ কাজ করছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে ‘টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে ১০ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

২৯ জুলাই ‘বিশ্ব বাঘ দিবস’ পালন উপলক্ষে সুন্দরবন সংলগ্ন জেলার মানুষকে সম্পৃক্ত করার জন্য গত কয়েক বছর ধরে ঢাকার বাইরে জাতীয়ভাবে পালন করা হয়েছে দিবসটি। বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এ বছর ভার্চুয়ালি পালন করা হচ্ছে দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘বাঘ বাড়াতে করি পণ, রক্ষা করি সুন্দরবন’।

দেশে বাঘের একমাত্র আবাসস্থল সুন্দরবনে চোরা শিকারি চক্র এবং জলদস্যু-বনদস্যুদের তৎপরতার কারণে কয়েক বছর আগেও অনেকটা হুমকির মুখে ছিল বাঘ। তবে, দস্যুরা আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসায় বিগত কয়েক বছরে চোরা শিকারিদের তৎপরতা কমে এসেছে।

বন বিভাগ জানায়, ২০১৩-২০১৫ সালে সুন্দরবনে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে প্রথম জরিপ করে বাঘ পাওয়া যায় ১০৬টি। দ্বিতীয়বার ২০১৭-২০১৮ মেয়াদে একই পদ্ধতিতে জরিপ করে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের ১১৪টি সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়।

বন বিভাগের তথ্য মতে, বাঘ আছে এমন দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২০ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত সুন্দরবনে নানাভাবে ৪৮টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগে ২২টি এবং পশ্চিম বিভাগে ১৬টি বাঘের মৃত্যু হয়। ওই সময়ের মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ১০টি বাঘের চামড়া এবং বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ধার করে।

সুন্দরবন বিভাগ জানায়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী, বাঘ হত্যা ও পাচার করলে কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। প্রথমবার কেউ এ অপরাধ করলে দুই থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং দুই থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বাঘ হত্যা বা পাচার করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড ও ১৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আবার বন বিভাগ থেকে পাস নিয়ে সুন্দরবন থেকে বনজ সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে কেউ বাঘের হামলায় নিহত বা আহত হলে তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে সরকার।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, বাঘ শিকারিদের তৎপরতা রুখে দিতে নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি স্মার্ট পেট্রোল চলছে সুন্দরবনে। বন বিভাগের পাশাপাশি সিএমসি, সিপিজি এবং বিটিআরসি নিয়মিত সুন্দরবন বাউন্ডারি এলাকায় টহল দেয়।

প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, সুন্দরবনে বাঘ রক্ষায় ‘বাঘ সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটির যাচাই-বাছাই চলছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে ওই প্রকল্প সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রাথমিকভাবে তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটি সরকারের অনুমোদন পেলে আগামী বছরের জানুয়ারি মাস থেকে কার্যকর হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি জানান, সুন্দরবনের মধ্যে বড় বড় নদীর কারণে বাঘ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ওই প্রকল্পে সুন্দরবনের মধ্যে এক স্থান থেকে বাঘ সরিয়ে অন্য স্থানে নেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এছাড়া একই বাঘ দ্বারা দীর্ঘদিন ধরে প্রজনন হলে পরবর্তী প্রজন্ম দুর্বল হয়ে পড়ে। এ জন্য বাঘ স্থানান্তর হলে প্রজননের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসবে। একইসঙ্গে প্রতি দুই বছর পর পর বাঘ জরিপের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বাঘের খাবার হরিণ এবং বন্য শূকর জরিপেরও প্রস্তাব রয়েছে। আর সুন্দরবন মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহারের প্রস্তাব রয়েছে ওই প্রকল্পে।