জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার আনুষ্ঠানিকতার পথে বাংলাদেশ

03(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ওই বছরের ২ আগস্টের ঘটনা।)

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অবশেষে ১৯৭২ সালের ৭ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন পেশ করবে বলে ঢাকায় পররাষ্ট্র অফিস সূত্রে জানানো হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ সদস্যপদের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে আবেদনপত্র পেশ করবেন। এদিকে ভোটাধিকার শক্তিসম্পন্ন দেশগুলোর মধ্যে কেবল একটি দেশ ছাড়া অন্যরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবু জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে দেশটি ভেটো প্রয়োগ করবে না বলে আশা করা যায়। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ বিশ্ব সংস্থার সদস্য হিসেবে যোগদান করবে বলে আশা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু ভালো আছেন

এদিকে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও লন্ডনের ক্লিনিকে অপারেশন শেষে সন্তোষজনকভাবে আরোগ্য লাভ করেছেন। গতরাতটি (১ আগস্ট) সম্পূর্ণ শান্তিতে অতিবাহিত করেছেন বলে শেষ খবরে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক সকালে (২ আগস্ট) বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে একটি বুলেটিন প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু দ্রুত নিরাময় হচ্ছেন এবং তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব অবস্থা সন্তোষজনক। অন্যদিকে তখনও বিভিন্ন এলাকা থেকে আরোগ্য প্রার্থনা করে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে শুভেচ্ছামূলক চিঠিপত্র ও তার বার্তা আসা অব্যাহত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর দ্রুত আরোগ্য কামনা করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারাল্ড উইলসন একটি চিঠি পাঠিয়েছেন তাকে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্ত্রী লেডি হিউম বঙ্গবন্ধুর আরোগ্য কামনা করে বেগম মুজিবের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।

এদিকে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর দ্রুত আরোগ্য লাভের খবরে আনন্দ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় তিনি জানান যে, ৪ আগস্ট সারা দেশে জাতীয় প্রার্থনা দিবস পালন করা হবে। দেশের বন্যাকবলিত এলাকায় রিলিফের সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

01যেকোনও মূল্যে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটির বর্ধিত সভায় সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে যেকোনও মূল্যে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য শপথ গ্রহণ করা হয়। ১৯৭২ সালের জুলাইয়ের শেষ থেকে পাঁচ দিন যাবত সাংগঠনিক কমিটির বৈঠক চলে। এতে সব জাতীয়-আন্তর্জাতিক সাংগঠনিক বিষয়টি আলোচিত হয় এবং বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। দলের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট কোরবান আলী এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। এই সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়। এই প্রস্তাবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্দেশ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, এর ফলে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সমাজে শ্রমিক-কৃষক শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা হবে।

গৃহীত আরেক প্রস্তাবে বলা হয় যে, জাতীয় আত্মত্যাগ, অনেক দুঃখ-দুর্দশা আর শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাউকে ষড়যন্ত্র করতে দেওয়া হবে না। বিভিন্ন দল ও মতাদর্শের ছদ্মাবরণে সাম্রাজ্যবাদের দালাল, জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী, বিপথগামী চরমপন্থী হতাশাগ্রস্ত অরাজনৈতিক বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এটি যেকোনও মূল্যে প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর।

সিমলা চুক্তির পক্ষে ফের ইন্দিরার ভাষণ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জোর দিয়ে বলেন, সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত ভবিষ্যতের মোকাবিলায় স্বীয় ভূমিকাকে জোরদার করেছে বলে। রাজ্যসভায় সিমলা চুক্তির সপক্ষে এক ভাষণে শ্রীমতি গান্ধী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এই চুক্তির ফলে আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে— এটা কেউ দাবি করেনি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমস্যা সব সময় বিরাজমান থাকবে। প্রতিটি পদক্ষেপের মাধ্যমে অগ্রগতি সাধন হবে, সেটাই আমাদের প্রচেষ্টা।’

02ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, ‘উপমহাদেশে উত্তেজনা বহাল রাখার অর্থ হলো—বাইরের হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়া। তাই প্রশ্ন হচ্ছে—এই ধরনের সুযোগ রাখা হবে কিনা।’ সিমলা চুক্তির মাধ্যমে শান্তির পথে যাত্রা শুরু হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুনিয়ায় পরিবর্তন আসছে। বলা হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তি এর আগে কার্যকর হয়নি। আমরা সেটি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা শান্তির প্রচেষ্টা পরিহার করবো।’