গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথমবারের মতো এই ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। এরপর ২০২০ এর অর্ধেকটা জুড়েই করোনা মোকাবিলায় রীতিমতো হিমশিম খেয়েছে বিশ্বের বড় বড় দেশ। করোনার বিস্তার রোধ করতে বিভিন্ন দেশে লকডাউন, জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছে। এই মহামারিতে এখনও জর্জরিত পুরো বিশ্ব। এরপরও করোনা মহামারির মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর লকডাউন ও কঠোর পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি এক সময় স্বাভাবিক হয়। পুরো শহর পরিচ্ছন্ন করে মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু সেখানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি চলার চার মাস পর আবার ভাইরাস ফিরে আসে।
করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করণীয় বিষয়ে বিবৃতি দিয়ে আসছে। তারা বলছে, করোনাভাইরাস যে আবার ফিরে আসবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। তবে ফিরে আসলে তার রূপ হবে আগের চেয়ে ভয়াবহ। এতে আবারও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে বিশ্ব। ফলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টার মধ্যে হ্যান্ডশেক, জনসমাগম, অনুষ্ঠান—এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। আবারও আগের মতো পরিস্থিতিতে ফিরতে সময় লাগবে বেশকিছু। সেটি জনগণের যেমন মাথায় রাখতে হবে, তেমনই সরকারের দায়িত্ব জনগণকে সীমিত পরিসরে স্বাভাবিক জীবন যাপনে সতর্ক করা। চলাফেরায় অসতর্কতা বিপদ ডেকে আনতে পারে। এছাড়া করোনাভাইরাস তার জিন পরিবর্তন করে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। ফলে ভাইরাস আর নেই, ভেবে নেওয়া যাবে না কোনোভাবেই।
চীন, ইতালিসহ যেসব দেশে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা বেশি দেখা গেছে, তারা ধাপে ধাপে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছে। গত মে মাসে ইতালিতে করোনায় মৃতের সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ৭৯ জন। আক্রান্তের সংখ্যা ছিল দুই লাখ ১১ হাজার ৯৩৮। এ পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জোসেফ কোঁতে দেশটিতে লকডাউন শিথিল ঘোষণা করেন। শুরুতে সীমিত আকারে বার, রেস্টুরেন্ট, খুচরা ও পাইকারি দোকানপাট, স্টেশনারি, বইয়ের দোকান, বাচ্চাদের কাপড়ের দোকান, কম্পিউটার ও কাগজপত্র তৈরির কাজ শুরুর অনুমতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে মে মাসের শেষের দিকে বাণিজ্যিক কিছু অফিস, প্রদর্শনী, জাদুঘর, প্রশিক্ষণ টিম, ক্রীড়া ক্ষেত্র এবং গ্রন্থাগার খোলার ঘোষণা দেওয়া হয়। লকডাউন শিথিল করা হলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সবাইকে গণপরিবহনসহ বাইরে মাস্ক ব্যবহার করতে এবং নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়।
গত মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই ক্রমশ স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে ইউরোপসহ গোটা বিশ্ব। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালির মতো দেশগুলোতে ধীরে ধীরে লকডাউন উঠে গেছে। করোনাকালে ইউরোপের অধিকাংশ দেশ নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দিলেও দেশগুলোর অর্থনীতি বাঁচাতে এখন পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছে সীমান্ত।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশের অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সংক্রমণের মাত্রা অনুযায়ী রেড জোন নির্ধোরণ করে লকডাউনেরও ঘোষণা আসে। দুই মাসের বেশি সময় পরে দেশে একদিনে সর্বাধিক কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের দিন ঘোষণা আসে, ৩১ মে থেকে অফিস খুলবে, বাস-লঞ্চ-ট্রেন-বিমান চলবে।
ভাইরাস সংক্রমণের দিক থেকে নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে এভাবে সব খোলার সিদ্ধান্তকে আত্মঘাতী মনে করছিলেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু দেশের অর্থনীতি সচল রাখার জন্য ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরারও তাড়া ছিল। যে দুই মাস সাধারণ ছুটি ও বাসা থেকে বের হওয়ায় বিধিনিষেধ ছিল, সেই দুই মাসে দিন ভিত্তিক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আয় ছিল পুরোপুরি বন্ধ। শুরুতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এসব খোলার ঘোষণা হয়। এরপর গত দুই মাসে পর্যায়ক্রমে সব বিধিনিষেধ উঠিয়ে নেওয়া হয়। যদিও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ ও মাস্ক বাধ্যতামূলকভাবে পরে চলার পরিপত্র এখনও জারি আছে।
খাপ খাইয়ে নেওয়া মহামারিকালের বড় চ্যালেঞ্জ- উল্লেখ করে প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের চিকিৎসক লেলিন চৌধুরী বলছেন, বিশেষ কারণে একটা পর্যায়ের পর আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরতে হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু এখনও বলতে পারছি না যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নেই, সেহেতু সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করার কাজগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। বিশ্বের যারাই মে মাসের পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে জীবনযাপন করতে গেছে, তারাই দ্বিতীয়বারের মতো সংক্রমণের শিকার হয়েছে। অফিস খুলে গেছে বলেই আপনি অনেকদিন পর দেখা হওয়া সহকর্মীর সঙ্গে করমর্দন করবেন সেটি হবে না। এই বিষয়গুলো অনবরত টেলিভিশনে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আগামীর যেকোনও বিপদ এড়াতে সতর্কতার কোনও বিকল্প নেই।
সোমবার (১০ আগস্ট) মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে ফের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় করোনা পরিস্থিতিতে মানুষকে আরও সচেতন থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কমে যাওয়ার বিষয়টি নজরে আসায় এই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ছবি : সাজ্জাদ হোসেন