সংবিধানে সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ

দৈনিক বাংলা, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ওই বছরের ৩০ অক্টোবরের ঘটনা।)

১৯৭২ সালের ৩০ অক্টোবর গণপরিষদে সংবিধানের ওপর সাধারণ আলোচনা সভা শেষ হয়। এদিন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বেশ কিছু বিষয়ে সমালোচনাকারীদের প্রশ্নের কঠোর জবাব দেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সংবিধানে জনগণকে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক করা হয়েছে। এদিন অসহায় শিশুশ্রম সংস্থার পক্ষ থেকে হেলকে ফেরি গণভবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একসেট কানাডীয় বই উপহার দেন। কালোবাজারিদের ধরতে অভিযান, রেশনে কারচুপির অভিযোগসহ নিয়মিত বিষয়গুলো পত্রিকার পাতাতে ছিলই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা রাজাকার ও আলবদর ছিল, তারা ঢাকায় গাঢাকা দিচ্ছে এবং কেউ কেউ ঢাকা হয়ে লন্ডনে পাড়ি জমাচ্ছে বলেও জানা যায়।

দৈনিক ইত্তেফাক, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২

প্রথম দফা আলোচনা শেষ, কাল দ্বিতীয় পর্যায়

বাংলাদেশ সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সংবিধানে জনগণকে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক করা হয়েছে। রাষ্ট্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।’ গণপরিষদে সংবিধানের সাধারণ আলোচনা সভায় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এক রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পরাধীনতার অভিশাপ ও উপনিবেশিক দাসত্বের শেকল ছিঁড়ে ফেলে বাংলাদেশের জনগণ হাতে নিয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা। জনগণ তথা কৃষক-শ্রমিকের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে।’ সকলের মিলিত প্রয়াসে সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। গণপরিষদের প্রথম পাঠ শেষ হলো। চার দিনব্যাপী সাধারণ আলোচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৪৮ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। এরপর দ্বিতীয় পাঠ শুরু হবে এবং আলোচনায় সংশোধনী প্রস্তাব বিবেচনা করা হবে। সংবিধানের সংশোধনী প্রস্তাবে ৯৩টি নোটিশ দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে। ৫৭টি সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছেন ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং ১৯টি সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। এছাড়া যৌথভাবে তারা আরও তিনটি সংশোধনী প্রস্তাবের নোটিশ দেন।

সংবিধানের সমালোচনাকারীদের সকল বক্তব্যের জবাব দিতে ড. কামাল হোসেন দুনিয়ার তাবৎ সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক দেশের শাসনতন্ত্র থেকে অসংখ্য উদ্ধৃতি দেন এবং বলেন, ‘সংবিধানের সমালোচনা করা হয়েছে উপনিবেশিক মানসিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমাদের সংবিধানকে বিচার করতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া হয়েছে ৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসনের ৪৫ সাল ও ৬২ সালের শাসনতন্ত্রের, কিন্তু এসব শাসনতন্ত্রে কিছু কিছু ভালো কথা থাকলেও জনগণের হাতে কোনও ক্ষমতা ছিল না। দেশের শাসন ব্যবস্থায় স্থান ছিল না জনগণের। কিন্তু আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। ক্ষমতা এখন জনগণের কাছে। তাই জনগণের ক্ষমতা ও তাদের প্রতিনিধিদের ওপর আস্থা রেখেই সংবিধান তৈরি করা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ অবজারভার, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২

পাকিস্তান আসলে কোনটি?

পাকিস্তান আসলে কোন অবস্থান নিচ্ছে এবং তাদের দেশটিইবা কে চালাচ্ছে, সে নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। সিমলা চুক্তি, নাকি ওয়াশিংটন, নাকি পিকিং—কোনটি আসলে পাকিস্তানের রূপ, তা নিয়ে ভারত সরকারের একটি মহল বেকায়দায় পড়েছে বলে নয়াদিল্লি থেকে আসা এক খবরের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আবারও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে’ বলে ওয়াশিংটনে পাক রাষ্ট্রদূত সুলতান মাহমুদ খানের উক্তিই এই উৎকণ্ঠার কারণ। তিনি সম্প্রতি সেন্ট লুই পোস্ট পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তার দেশের সঙ্গে ভারতের নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’

সুলতান মাহমুদ খানের এই কথায় পাকিস্তানের সম্পর্কে ধাঁধার সৃষ্টি করে। ইয়াহিয়া খানের এককালীন প্রধান পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা সুলতান মাহমুদ খান বলেছেন, জুলাইয়ে আলোচনা শুরু, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা না করলে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে আবারও যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। সীমান্তের অবস্থা বর্তমানে অনিশ্চিত। তাই নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

দৈনিক বাংলা, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২

আলবদর-রাজাকাররা ঢাকায়

দেশের বিভিন্ন জেলার কুখ্যাত দালাল ও নরপশুদের গাঢাকা দেওয়ার একটি নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছিল রাজধানী ঢাকা। শহরে স্বাধীনতার পর থেকে আশ্রয় নিতে শুরু করে বাইরে থেকে আসা রাজাকার, আলবদর ও শান্তিবাহিনীর ব্যক্তিরা। স্বাধীনতাবিরোধী কলঙ্কজনক অধ্যায় গোপন করে ঢাকা শহরে বসবাস করছিল তারা। মাঝে মধ্যে এই ধরনের কয়েকজন পলাতক দালাল পুলিশের হাতে ধরাও পড়ছিল।

দৈনিক বাংলার সিলেট প্রতিনিধি জানান, দালালরা শাস্তি এড়াবার জন্য ঢাকা হয়ে লন্ডনও পাড়ি দিচ্ছে। দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, কিংবা যারা দালালির অভিযোগে অভিযুক্ত, তাদের অনেকেই এখন শাস্তি এড়ানোর জন্য লন্ডনে পাড়ি জমাচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, দালালেরা নামে বা বেনামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে ঢাকা হয়ে বিদেশ চলে যাচ্ছে। সে সময়েই কমলগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত বেশ কয়েকজনের লন্ডন চলে যাওয়ার খবর জানা যায়।