সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষর বঙ্গবন্ধুর

3(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা।)
১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতি তার সূর্যসন্তানদের হারানোর বছরপূর্তির শোকের মধ্যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে, যখন কিনা গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষর করেন। এটা এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে স্বাধীন বাংলার এগিয়ে চলার এক অনন্য নজির। পরিষদ সদস্যদের ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও এবং মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে দিয়ে গণপরিষদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে প্রথম স্বাক্ষর করেন। গণপরিষদ সংবিধানের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান দেখার জন্য দর্শকদের সারিতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বিদেশি কূটনীতিকদের বহু সংখ্যক সদস্য ও বিশিষ্ট দর্শকরা গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের আসন গ্রহণ করেন। প্রথমে সংবিধান ও পরে ইংরেজিতে অনুমোদিত অনুবাদের পাঠ শুরু হয়। এইদিন দীর্ঘ মুলতবির পরে গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে বঙ্গবন্ধুর পরে একে একে ৩৫৭ জন সদস্য এদিন সংবিধানে স্বাক্ষর করেন।

1

আজ আমি ধন্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে স্বাক্ষর করার পরে আনন্দভরা কণ্ঠে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, আজ আমি ধন্য। এই স্মরণীয় মুহূর্তে আমাদের জনগণও গর্বিত।

গণপরিষদে বাংলাদেশ সংবিধানের পাঠ এবং ইংরেজিতে অনূদিত একটি অনুমোদিত পাঠ নির্ভরযোগ্য বলে সার্টিফিকেট প্রদান এবং সদস্যদের স্বাক্ষরিত সংবিধান ও ইংরেজি অনুবাদের একটি কপি করে জাতীয় জাদুঘরের সংরক্ষণের জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, সংবিধান কারুকার্যমণ্ডিত করেছে আমাদের শিল্পীরা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরিচালনায় কাজটি সমাপ্ত হয়েছে। এর প্রতিটি পাতায় পড়েছে তাদের তুলির আঁচড়। অনুষ্ঠানের উপযোগী করার জন্য তারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। এই ড্রইংয়ের মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির মেহনতি মানুষের সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। এ কাজের জন্য শিল্পী ও সরকারি কর্মচারীদের তিনি অভিনন্দন জানান।

2

সেনাবাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির আলোকে দেশে একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান। বাংলার বীর সেনানী নামক একটি স্মারক গ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষে এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীর প্রতি এই আহ্বান জানান। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে আন্তসার্ভিস গণসংযোগ থেকে বাংলার বীর সেনানী নামক গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী দেশ গঠনের কাজে জনগণের পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান বলে এনা খবর দেয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, শৃঙ্খলা আত্মবিশ্বাস ছাড়া কোনও জাতি পরিপূর্ণতা  লাভ করতে পারে না। সুতরাং সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য আপনাদের নীতির দ্বারা পরিচালিত হয়ে শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ ও দুষ্কৃতিকারীদের চিরদিনের জন্য উৎখাত করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে হবে স্বাধীনতার ফল।

বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর বীর সেনানীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, সেনাবাহিনীর ভাইয়েরা, আমার আপনারা সকলেই এই মাটির সন্তান এবং দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ সুখের সমভাগী আপনাদের হতে হবে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বদেশকে গড়ে তোলার কাজে তাদের পাশে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে।

4

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা নিবেদন

যে গোপন ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য দায়ী, একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার রহস্য উদঘাটন করে জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতার সূর্যসারথী শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আলোচনায় সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানানো হয়। বেদনাহত জাতি এইদিন শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে লাখো শহীদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের মানুষ শহীদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে বহুমূল্যে অর্জিত স্বাধীনতাকে সংহত ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থির থাকার শপথ নেয়।

১৯৭১ সালের এই দিনে সভ্যতার নিষ্ঠুরতায় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, চিকিৎসাধীন সংস্কৃতিসেবীরা। এই হত্যাকাণ্ডের পিছনের প্রকৃত অপরাধীদের বিচার অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্মরণিকা প্রকাশ, সভা সমাবেশ, বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক প্রদান, প্রতিবাদী গানের আসরসহ নানা আয়োজন ছিল।