‘ভারত চাইছে, বাংলাদেশ দিচ্ছে—বিষয়টা শুধুই এরকম নয়’

বিক্রম দোরাইস্বামীভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে শুধু ভারতের চাওয়াগুলোকেই পূর্ণ করে যেতে হচ্ছে, বিষয়টাকে সেই দৃষ্টিতে না দেখার অনুরোধ জানালেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বিক্রম দোরাইস্বামী। পাশাপাশি বাংলাদেশ রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার পরোয়া না করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্বার্থে বহু সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।
কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি যে সব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত টেনে ভারতীয় হাইকমিশনার এদিন দাবি করেছেন, ‘এতে কিন্তু উভয় দেশেরই লাভ হচ্ছে। বাংলাদেশ যেমন দিচ্ছে, তেমনি পাচ্ছেও।’

আগামী বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলনের প্রাক্কালে শিলংয়ের থিঙ্কট্যাঙ্ক ‘এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স’ যে অনলাইন আলোচনাসভার আয়োজন করেছিল, সেখানেই ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) এই মন্তব্য করেন।

সেই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও। তিনি সেখানে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাও কিন্তু এমন বহু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেখানে দেশের ভেতরে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হবে কিংবা নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না তার তোয়াক্কা করেননি!’

বস্তুত বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ‘কানেক্টিভিটি’ রাজনৈতিকভাবে বেশ স্পর্শকাতর বিষয় ছিল মাত্র কিছুদিন আগেও। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সড়ক, রেল বা নৌপথে ভারতকে ‘ট্রানজিট’-এর অধিকার দেওয়া উচিত কি না, বা দিলেও কী শর্তে বা কোনও মূল্যে দেওয়া উচিত তা নিয়ে সেখানে রাজনৈতিক বিতর্কও বহু পুরনো।

সেই প্রসঙ্গের অবতারণা করেই এদিনের আলোচনাসভায় মি. দোরাইস্বামী বলেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সব  সংযোগ বা কানেক্টিভিটি প্রকল্প সম্প্রতি বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলোর অর্জন কিন্তু ‘নেট পজিটিভ’  অর্থাৎ সার্বিকভাবে উভয় দেশের জন্যই ইতিবাচক। এটাকে ভারত চাইল আর বাংলাদেশ দিল এভাবে দেখাটা সমীচীন হবে না, কারণ এখানে দুই দেশই লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ যেমন দিচ্ছে, তেমনি পাচ্ছেও।’

গত বছর প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় এলপিজি রফতানির যে চুক্তি হয়েছিল, এই প্রসঙ্গে সেই দৃষ্টান্তও টেনে আনেন তিনি। বিক্রম দোরাইস্বামী বলেন, ‘এই এলপিজি রফতানি নিয়েও বাংলাদেশে একটা সময় ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল। এখানে যেটা হয়েছে, বাংলাদেশ বিদেশ থেকে সুবিধাজনক দরে যে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস আমদানি করছে তারই একটা অংশ বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো ভারতের ত্রিপুরায় পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদে কিন্তু এখানে হাত পড়ছে না, বরং তারা ব্যবসা পাচ্ছে এবং ভারতও অনেক কম খরচে ত্রিপুরার মতো রাজ্যে গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে দিতে পারছে।

ফলে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দাবি করছেন, এখানে একটা দেশ লাভবান আর অন্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিষয়টা আদৌ সেরকম নয়। বরং ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের জন্যই এটা একটা ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’।

বাংলাদেশে সিলেট, কক্সবাজার বা পার্বত্য চট্টগ্রামে ইদানীং যেমন সব বিলাসবহুল রিসোর্ট বা অবকাশ-যাপন কেন্দ্র গড়ে উঠছে, দুই দেশের মধ্যে উন্নত অবকাঠোমোর সুযোগ নিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকেও এখন বিপুল সংখ্যক পর্যটক এখন সেখানে আসবেন বলে তিনি জানান।  আলোচনাসভায় বিক্রম দোরাইস্বামীর ঠিক পরেই তার বক্তব্য পেশ করেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম

তিনি মন্তব্য করেন, ‘গত কয়েক বছরে ভারত ও বাংলাদেশ যেভাবে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতাকে প্রসারিত করেছে, স্থল সীমান্ত চুক্তি থেকে শুরু করে সমুদ্রসীমার নির্ধারণ চূড়ান্ত করেছে, কানেক্টিভিটি থেকে বিদ্যুৎ-জ্বালানির ক্ষেত্রে নতুন নতুন সমঝোতা করেছে তাতে আরও কিছু পাওয়ার জন্য মানুষের প্রত্যাশা বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’

থিঙ্কট্যাঙ্ক এশিয়ান কনফ্লুয়েন্সের করা একটি জরিপে ভারত-বাংলাদেশের মানুষ দুদেশের কাছ থেকে আরও অনেক সহযোগিতা চায়, এই ফলাফলই বেরিয়ে এসেছে। শাহরিয়ার আলম তার সূত্র ধরেই ওই মন্তব্য করেন।

বিগত দশ-বারো বছরে অনেক ‘রাজনৈতিক ঝুঁকি’ নিয়েও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, সে কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। 

বৃহস্পতিবারের শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ভারতের কাছ থেকে আরও সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা দাবি করবে, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কথায় সেই ইঙ্গিতও ছিল। ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে এখন ভারত এই ক্ষেত্রে আরও অর্থবহ ভূমিকা পালন করতে পারে বলেই আমরা মনে করি’, মন্তব্য করেছেন তিনি।