প্রতিষ্ঠা হলো সুপ্রিম কোর্ট

2

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বরের ঘটনা।)
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের মূলনীতির ভিত্তিতে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বিকালে সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী উৎসব উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু এই আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিক, দূতাবাসের পদস্থ কর্মচারী, বিপুল সংখ্যক আইনজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, দেশে আইনের শাসন কায়েম হবে। কারণ আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। আমরা রাজনীতি করেছি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। বঙ্গবন্ধু বলেন, চারটি রাষ্ট্রীয় স্তম্ভের ওপর দেশ চলবে এটাই সংবিধানের মূল কথা। সংবিধানের এবং নীতির ওপর ভিত্তি করে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। সংবিধানের মূলনীতির ওপর যাতে কেউ হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। সংবিধানের উপযুক্ত প্রয়োগ যাতে হয় তাও দেখতে হবে। এই ব্যাপারে মতামত দেওয়ার অধিকার আদালতের আছে কারণ আদালতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কেউ তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করবে না।
আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগ পৃথক প্রসঙ্গে
আইন বিভাগ শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা বলি বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হবে। কিন্তু বিচার বিভাগ পৃথক করা যায় না। সরকারের সকল বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা না থাকলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তবে আইনে কোনও গোলমাল থাকলে বিচার বিভাগ অবশ্যই আপত্তি দেবেন। সর্বোপরি আমরা কীভাবে কাজ করি তার ওপরই নির্ভর করে আইনের শাসনের রূপায়ন।
বিচার বিভাগের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, দেশের অবস্থা ও জনগণের মানসিকতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিচার বিভাগকে কাজ করতে হবে। সেজন্য পরস্পরের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযোগিতা দরকার। সংবিধান আদর্শকে রক্ষা করার জন্য তিনি আহ্বান জানান।

1
বিচারকার্যে বাংলা প্রয়োগ
বিচারকার্যে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সম্পর্কিত প্রধান বিচারপতির একটি সুপারিশের ওপর মতামত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আইনের জন্য পরিভাষা তৈরির উদ্দেশে কমিশন করার দরকার নেই। কারণ আমরা বাংলা ভাষাতেই শাসনতন্ত্র তৈরির মত দুরূহ কাজ করে ফেলেছি। এখন আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে ফেলেন সমস্যা মিটে যাবে। কাজের মাধ্যমে অসুবিধা দূর হবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, লক্ষ লক্ষ শহীদের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতার প্রতীক কারণ সুপ্রিম কোর্ট, এটি না হলে জাতি পরিপূর্ণতা লাভ করে না। স্বাধীনতা যুদ্ধে আইনজীবীর আত্মত্যাগের কথা তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
প্রধান বিচারপতির বক্তব্য
প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম তার ভাষণে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনাবলীর অতন্দ্র প্রহরী। রাষ্ট্রের তিনটি প্রধান অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ আইনসভা এবং বিচার বিভাগ স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ও স্বাধীন হলেও প্রত্যেককে সংবিধানের নির্দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়। কোনও বিভাগ কর্তৃক আইন নির্দিষ্ট গণ্ডি সীমা অতিক্রম করেছে কিনা তা পরীক্ষার মৌলিক দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্ট পরিচালিত বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগ এই মহৎ দায়িত্ব নিরলস, কর্তব্যনিষ্ঠ ও বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন আইনজীবী সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠুভাবে পালন করতে সক্ষম হবে না। আইনজীবীর সম্প্রদায় তাই আমাদের বিচার বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রধান বিচারপতি বলেন, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন ও বিচার বিভাগীয় কর্তব্যের সুনির্বাহ নির্ভর করছে বিচার বিভাগ সম্পর্কে অন্যান্য বিভাগের সঠিক মূল্যায়নের ওপর। সাম্য স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের যে আদর্শ রূপরেখা সংবিধানে প্রতিফলিত হয়েছে তার রূপায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের আইন সভা ও নির্বাহী বিভাগের।

3
বঙ্গবন্ধু গোটা বিশ্বের মহান নেতা
রবীন্দ্রনাথের পর বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য সর্বাধিক সুনাম অর্জন করেছে। একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের জন্য বিশ্বব্যাপী এই জন্য সুনাম অর্জন করেছেন বলে মন্তব্য করেন প্রখ্যাত গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলাদেশ টেলিভিশনের বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। ‘একটি মুজিবরের কণ্ঠে’ বিখ্যাত গানটির রচনা সম্পর্কে তার অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে বলে সংবাদে প্রকাশ হয় ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শন
১৯৭২ সালের এইদিনে সকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আকস্মিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে যান। পররাষ্ট্র দফতরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা আলোচনা করেন আলোচনা বৈঠকের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
বিচারপতি ও আইনজীবীদের প্রতি রাষ্ট্রপতি
দেশে কঠোরভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানের স্বীকৃত মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিচারপতি ও আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপতি দেশের সংবিধানের অধীনে সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনকালে ১৯৭২ সালের এইদিন সকালে ভাষণদানকালে এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে প্রধান বিচারপতি এবং আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। নতুন সংবিধানের অধীনে সুপ্রিমকোর্টের কার্যপদ্ধতিকে রাষ্ট্রপতি ‘ঐতিহাসিক’ বলে বর্ণনা করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় হিসাবে সুপ্রিমকোর্ট অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে। তিনি বলেন, সুপ্রিমকোর্টের এই কার্যদিবসটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিবস হিসেবে বিরাজ করবে। রাষ্ট্রপতি সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি ও আইনজীবীদের ওপর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, যখন জনগণ ন্যায় বিচার পাবে তাদের অধিকার সংরক্ষণ হবে তখনই দায়িত্ব পূর্ণ হয়েছে বলে বিবেচনা করা হবে। সংবিধানের বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ও এর পূর্ণ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধানের বিষয়টি উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, এটা খুবই আনন্দের বিষয় যে এই ধরনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।