সমাজ হোক শোষণ ও দুর্নীতিমুক্ত

দৈনিক বাংলা, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ওই বছরের ২২ ডিসেম্বরের  ঘটনা।)

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ এবং দেশকে গড়ে তোলার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।  ১৯৭২ সালের ২২  ডিসেম্বর ছিল সেই দিন, যেদিন দেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে সৌধ নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর  উদ্বোধন করা হয়েছিল। এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে গিয়ে শহীদদের স্মরণ করবে জাতি। মিরপুরে বর্বর পাক বাহিনীর নির্দেশে আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু এ আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবার-পরিজন, বিদেশি কূটনীতিক, মন্ত্রিসভার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২শহীদদের আদর্শে দেশ গড়ার অঙ্গীকার

ভাবগম্ভীর পরিবেশে এই অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন ‘বুদ্ধিজীবীরা যে আদর্শের জন্য জীবন দিয়ে গেছেন, সে আদর্শ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। যতদিন বাংলার মানুষ পেট ভরে খেতে না পারবে, দেশ থেকে অত্যাচার-অবিচার দূর না হবে, শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম না হবে, ততদিন শহীদদের আত্মা তৃপ্তি পাবে না।’ তিনি বলেন, ‘মানুষ আজ না খেয়ে আছে, তাদের পরনে কাপড় নেই। দুর্বৃত্তরা তাদের সব ছিনিয়ে নিয়েছে। আসুন, আমরা সবাই মিলে শহীদদের আদর্শে দেশকে গড়ে তোলার জন্য আত্মনিয়োগ করি।’

ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ

দেশ থেকে ঘুষ-দুর্নীতি দূর করার জন্য যদি আমরা চেষ্টা করি, তবে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে বলে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি আজও আমার মনে পড়ে। তাদের চেহারা আমার চোখের সামনে ভাসে। তাদের অনেকের সঙ্গে আমি পড়েছি। অনেকের সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন কারাগারে ছিলাম। তাদের লেখা আমি পড়তাম। রাজনীতিতে তারা অনেকে আমাকে সাহায্য করেছেন। এদের মধ্যে অনেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাদের লেখনী দিয়ে তারা বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু কারাগার থেকে বেরিয়ে আমি আর তাদেরকে দেখতে পাইনি।’

বাংলাদেশ অবজারভার, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ক্ষমা তারা পাবে না

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন। সুপরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল ঠাণ্ডা মাথায়। আলবদর, রাজাকার ও আলশামসের লোকেরা বাড়ি থেকে বের করে এনে তাদেরকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে ছিলেন— শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলী।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এমন অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের পর তাদেরকে নাকি ক্ষমা করতে হবে। তাদের নাকি বিচার করবো না। কী জবাব দেবো আমি শহীদদের মা-বোনদের কাছে? তাদের ছেলেমেয়েদের আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছে?’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে কারও প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই। প্রতিহিংসায় আমরা বিশ্বাস করি না। তবে আমরা ইনসাফে বিশ্বাস করি।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকহানাদার দস্যুরা মনে করেছিল, তারা আর বাংলার মাটিতে থাকতে পারবে না। তাই আত্মসমর্পণের আগেই শুরু করেছিল বুদ্ধিজীবীদের নিধন। তারা মনে করেছিল, অত্যাচার করলে আমরা আত্মসমর্পণ করবো। কিন্তু তারা জানে না বাংলার ইতিহাস। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লড়াই সর্বপ্রথম শুরু হয় বাংলাদেশে। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে গেছেন বাংলার তিতুমীর, সূর্যসেন। সিপাহী যুদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশ থেকেই ‘ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মিরপুরের স্মৃতিসৌধ করা হয়েছে এই জন্য যে, এখানেই একত্রে বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া মিরপুরে এখনও অনেক হাড় পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের অন্য কোনও জায়গায় একসঙ্গে এত লোককে হত্যা করা হয়নি।’

দৈনিক বাংলা, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২ন্যায্যমূল্যের দোকানে জিনিসের অভাব

দীর্ঘ আড়াই মাসেও কনজিউমার সাপ্লাই করপোরেশন ন্যায্যমূল্যের দোকানের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে পণ্যদ্রব্য সরবরাহের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সফল হয়নি। ১৯৭২ এর অক্টোবর মাস থেকে করপোরেশন সারাদেশে চার হাজার সাতশো ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করার কথা ঘোষণা করা হয়। তখন থেকেই কিছু ন্যায্যমূল্যের দোকান ও পণ্যদ্রব্য সরবরাহের ব্যাপারে করপোরেশনের ব্যর্থতার অভিযোগ পাওয়া যায়। পণ্যদ্রব্য সরবরাহ ও দোকান চালুর জন্য সংস্থা প্রায় ২৩ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত করলেও দেশের শহর অঞ্চল ব্যতীত দূর-দূরান্তের দোকানগুলো ডিসেম্বরে এসেও সঠিকভাবে চালু হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।