সমাজবিরোধীদের রুখে দেওয়ার আহ্বান বঙ্গবন্ধুর

দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭২(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ওই বছরের ২৫ ডিসেম্বরের  ঘটনা।)

আমি আপনাদের কাছে আমার প্রতিনিধি পাঠাবো। যদি আপনারা মনে করেন জাতির পুনর্গঠন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার প্রয়োজন আছে, তাহলে তাদের নির্বাচনে জয়যুক্ত করবেন। সোনার মানুষ তৈরি করুন। ১৯৭২ সালের ২৫ ডিসেম্বর যশোরে এক বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হলে সোনার মানুষ তৈরি করতে হবে।’ তিনি সোনার মানুষ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

এ সময় হাজার হাজার জনতা হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আস্থা ও সমর্থন প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলার মানুষকে আমার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না। আমার জীবন জনগণের সেবায় নিবেদিত।’ পরিহাসের ছলে তিনি বলেন, ‘একমাত্র ডাইনিরাই মায়ের চেয়ে বেশি দরদ দেখায়।’ ‘ফাঁসির মঞ্চ বরণ করতে গিয়েছি, কিন্তু কখনও নীতির প্রশ্নে আপস করিনি’ উল্লেখ করে সেদিন তিনি ২৫ বছরের সংগ্রামে তার ওপরে নির্যাতনের কাহিনি বর্ণনা করেন।

সমাজবিরোধীদের রুখে দিন

সমাজবিরোধী চোর-ডাকাত, চোরাকারবারি ও দুর্নীতিবাজরা জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তাকে হরণ করছে। তাদের অপরাধমূলক তৎপরতা কোনোমতে বরদাশত করা যেতে পারে না। সরকার কঠিন হাতে সমাজবিরোধীদের তৎপরতা বন্ধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা। যশোরে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব কথা বলেন।

উত্তাল জনসমুদ্রের কাছে তিনি জানতে চান, এসব সমাজবিরোধীকে নির্মূল করার ব্যাপারে জনগণ সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে কিনা। তখনও জনতা দুই হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দেন। তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনী, রক্ষীবাহিনী ও পুলিশসহ শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো জনগণের শান্তি আনতে সদা জাগ্রত।’ যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রওশন আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদও ভাষণ দেন।

দৈনিক বাংলা, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭২

উৎপাদন বৃদ্ধি করুন

বঙ্গবন্ধু কৃষক সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের উৎপাদন বাড়িয়ে সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে স্থান পেতে হলে ক্ষেতে-খামারে-কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।’ তিনি দেশের বর্তমান খাদ্য সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘দেশের উন্নয়নের জন্য যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা প্রয়োজন ছিল, আজ বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করার জন্য তা ব্যয় করতে হচ্ছে।’

বাকহারা হয়ে যাই

বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘জনগণের ভালোবাসা দেখে আমি বাকহারা হয়ে পড়ি। যখন দেখি, কোনও পুত্রহারা পিতা আমার কাছে এসে বলেন যে, যদি আমি জাতির সেবা করার জন্য বেঁচে থাকি, তাহলে তিনি তার সন্তানের জন্য আক্ষেপ করবেন না। তখন আমি অভিভূত ও বাকহারা হয়ে পড়ি।’ সরকারের সমালোচকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সরকারের ভূমিকা সমালোচনার পূর্বে তাদের উচিত জনগণের জন্য সামান্য হলেও কিছু কাজ করা।’ প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে শহীদ মসিউর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন এবং বলেন, ‘আমি ভাবতেও পারিনি যে মসিউর রহমানকে আর কোনোদিন দেখবো না। তার মৃত্যু শুধু দেশের না, আমার নিজের পক্ষে এ ক্ষতি অপূরণীয়।’

বাংলাদেশ অবজারভার, ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭২বাংলার মাটিতে বিচার হবে

পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা বিবৃত করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘তারা ঠান্ডামাথায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ২৪ বছর ধরে তারা বাংলাদেশের সম্পদ লুণ্ঠনের যে পরিকল্পনা চালিয়েছিল, একাত্তরের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ সে পরিকল্পনারই অংশ। এই নির্যাতন ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। আমি যদি বেঁচে থাকি, তবে ইনশাআল্লাহ বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই।’

ভিয়েতনাম থেকে বিদেশি সৈন্য হটাও

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভিয়েতনামের মাটি থেকে সব বিদেশি সৈন্য দল সরানোর দাবি জানান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সশস্ত্র সংঘর্ষের পথ পরিত্যাগ করে শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির পথ অনুসরণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু এই দিনে বাসসের প্রতিনিধির কাছে বলেন, ‘নতুন করে যুদ্ধের বিস্তার এবং অন্যান্য বেসামরিক এলাকায় মার্কিনি বোমাবর্ষণের ঘটনায় গোটা বিশ্ববাসী মর্মাহত হয়েছে।’