কারাগারের সেই প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের এই দিনে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এই প্রকোষ্ঠে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে তাকে আটক রাখা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকালে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত দীর্ঘ ১৩ মাস বঙ্গবন্ধুকে এককভাবে আটক রাখা হয়েছিল। সেই গণঅভ্যুত্থানের ফলেই পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই প্রকোষ্ঠটি পরিদর্শন করেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে প্রকোষ্ঠের সামনের অংশের চারপাশের এলাকাটি ঘুরে দেখেন। এই স্থানটি ঘুরে দেখার সময় বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে সেই সময়ের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রকোষ্ঠ থেকে ভ্রমণের জন্য বের হয়ে আসার মুহূর্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল।’ লেফটেন্যান্ট নসরুল্লাহ নামে এক কাশ্মিরি অফিসার নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে কীভাবে বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষা করেছিলেন, সেই বিবরণ দেন তিনি।

দৈনিক বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ওই সেনা কর্মকর্তা আগেই বঙ্গবন্ধুর জীবননাশের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তাকে  সাবধান করে দিয়েছিলেন। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধু ভ্রমণের জন্য আর বাইরে বের হতেন না। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল। এর জন্য সেই কর্মকর্তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। প্রথমে তাকে বদলি এবং পরে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস পরিদর্শনকালে বলেন, ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজেদের প্রমাণ করেছেন।’ বঙ্গবন্ধু এদিন তিন ঘণ্টাব্যাপী ঢাকা সেনানিবাস পরিদর্শন করেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, অফিসার ও জওয়ানদের ট্রেনিংয়ের মান দেখে তিনি আনন্দিত হয়েছেন। ঢাকা সেনানিবাস পরিদর্শনকালে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন অসুবিধার মধ্যে অফিসার ও জওয়ানদের সুষ্ঠু ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ অবজারভার, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩জাতিসংঘ মহাসচিব আসছেন

জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল কুর্ট ওয়াল্ড হেইম ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিশেষ বিমানযোগে ইসলামাবাদ থেকে নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকায় আসার কথা পত্রিকায় জানানো হয়। তার পরিকল্পনায় ছিল ২৪ ঘণ্টা তিনি ঢাকায় অবস্থান করবেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ ও বেগম সামাদ সম্মানিত অতিথিকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাবেন এবং বিমানবন্দর থেকে তাদের সরাসরি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে নিয়ে যাওয়া হবে। বাংলাদেশে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদের সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিব উপমহাদেশের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলাপ করবেন বলে জানানো হয়। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবেন। বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় পাকিস্তানে আটক বাঙালি, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থা, উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশের খাদ্য সমস্যা এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে আলোচনা হবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা মঞ্জুর

১৯৭২ সালের মার্চ থেকে ৭৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ৭ কোটি ১৬ লাখ ২১ হাজার টাকা সাহায্য মঞ্জুর করা হয়। এই অর্থ সাহায্য থেকে ৪০ হাজার ৯৯৬টি পরিবার উপকৃত হয়। এদিন এক তথ্যবিবরণীতে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলের সাহায্য মঞ্জুরি হতে যারা উপকৃত হয়েছেন, তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে নিহত ও নিখোঁজের পরিবারবর্গ রয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা পঙ্গু অথবা আহত হয়েছেন, তারাও এর মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন।

দৈনিক বাংলা, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ প্রয়োজন তদন্ত কমিশন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে এবং পরে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে বহু নিরীহ লোক বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন কারাগারে আটক রয়েছেন বলে জানা যায়। এদের মধ্যে বহু মুক্তিযোদ্ধা, বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান এবং সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রয়েছেন। ভারতের কারাগারে যেসব ব্যক্তি আটক রয়েছেন, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদ হয়েছেন বলে তাদের আত্মীয়রা মনে করেছিলেন। কিন্তু বছরখানেক পরে ভারতের বিভিন্ন কারাগার থেকে অভিভাবকরা তাদের চিঠি পেতে শুরু করেন। অনেক অশিক্ষিত অভিভাবক থানায় থানায় ঘুরে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কেউবা ঢাকায় এসে অফিসে অফিসে ঘুরে কোনও সদুত্তর পাচ্ছিলেন না। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ভারতের বিভিন্ন কারাগারে যেসব ব্যক্তি আটক রয়েছেন, তাদের ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে গোটা ব্যাপারটি অনুসন্ধান করে দেখতে পারে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের ছাড়িয়ে আনার জন্য বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।