নির্বাচনের আগে ডিসি ও এসপিদের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)

জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের আসন্ন প্রথম সাধারণ নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হতে পারে, তার সমুচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সর্বস্তরের কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ দেন। দেশের স্বাধীনতা-উত্তর জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচন পরিপূর্ণ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর সরকারের উদ্যোগের কথা পুনরায় দীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

১৯৭৩ সালের এই দিনে (১০ ফেব্রুয়ারি) গণভবনে আগত বিভিন্ন জেলার ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপারদের সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু এ কথা বলেন।

দৈনিক বাংলা, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩গণতান্ত্রিক পরিবেশে দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বঙ্গবন্ধু

এই সম্মেলনে বাংলাদেশের সকল জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ছাড়াও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল পদস্থ কর্মকর্তাসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে নির্বাচন সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সরকারি দল এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কোনও রকম বৈষম্য না করার জন্য উপদেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের অধিকারের সঙ্গে দায়িত্বও রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে স্বীকৃত নীতিমালা এবং ঐতিহ্য রয়েছে, প্রত্যেকেরই তা অবশ্যই মেনে চলা উচিত। অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটদানের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের ওপর দায়িত্ব রয়েছে। যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে, তার নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব সরকারি কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত।’ প্রধানমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ—এই চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির বিরোধী যেকোনও প্রয়াস কঠোর হস্তে  প্রতিহত করা হবে।’

সাম্প্রদায়িকতার উসকানির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তানি শাসনামলে একদিন যে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প রাজনৈতিক পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলেছিল, পুনরায় সেই সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে তারা পুনরুজ্জীবিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বাংলাদেশ অবজারভার, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকের কোনও সম্ভাবনা নেই

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠকের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইম যতটুকু আশাবাদী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঠিক ততখানি আশাবাদী নন। চারদিনের সফর শেষে কাঠমান্ডু থেকে নয়াদিল্লি ফিরে ইন্দিরা গান্ধী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আগে পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে বসার বিষয়টি বাংলাদেশের নেতাদের ওপরে নির্ভরশীল।’ ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা শেষে জাতিসংঘ মহাসচিব যে মন্তব্য করেন, তার আলোকে মন্তব্য করার জন্য একজন সাংবাদিক ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানালে তিনি বলেন, ‘যারা ভারতে আটক পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি প্রদানের ব্যাপারে আগ্রহী, তারা পাকিস্তানে আটক বেসামরিক বাঙালি নাগরিকদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করতে আগ্রহী বলে মনে হয় না।’  

এর আগে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কাঠমান্ডুতে বলেন যে, ‘প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে আরও একটি শীর্ষ বৈঠক হওয়া এবং বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া পাকিস্তানের যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।’

জাতিসংঘের ত্রাণকার্য অব্যাহত থাকবে

বাংলাদেশে আনরডের ত্রাণকার্য ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের পরেও জাতিসংঘের ত্রাণকাজ অব্যাহত থাকবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘এ ব্যাপারে সবার পরামর্শ নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। মার্চ মাসে ত্রাণ প্রত্যাহার করার কথা থাকলেও যেকোনও অবস্থাতেই হোক, এটি যতদিন প্রয়োজন ততদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’

দৈনিক বাংলা, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

পাকিস্তানের স্বীকৃতি সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে

এই এলাকার সমস্যাগুলো জটিল এবং দুরূহ হলেও পরিস্থিতির বর্তমান অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব বলে মনে করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। উপমহাদেশে সফর সমাপ্ত হওয়ার আগে তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ঢাকায় ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় সফরকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জাতিসংঘ প্রধান ৭০ মিনিট ধরে দ্বিতীয় ও শেষ দফা বৈঠকে আলাপ করেন।

এর কয়েক মিনিট আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন কুর্ট ওয়াল্ডহেইম। ব্যাংককের পথে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এখানকার আলোচনায় তিনি খুবই সন্তুষ্ট।’ তিনি মনে করেন, পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফেরত আনার বিষয়টিসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের উপায় উদ্ভাবন নিয়ে আলোচনা সহায়ক হবে। মহাসচিব বলেন, ‘রাতারাতি সমস্যার সমাধান আশা করা যায় না। আপনারা ইন্দ্রজালিক সমাধান আশা করতে পারেন না। কারণ, সমস্যাগুলো পরস্পর সংযুক্ত।’ মহাসচিব এর আগে পাকিস্তান সফর করেছেন। তিনি বলেন, ‘সমস্যাগুলো সমাধানে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতিদান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ মহাসচিব জানান, স্বীকৃতি এবং আটক বাঙালিদের দেশে ফেরত আনার বিষয়ে তিনি এখানে ব্যাপক আলোচনা করেছেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তার ধারণা, সমস্যা সমাধানে উভয় পক্ষের গভীর আগ্রহ ও আন্তরিকতা আছে।’