সোনার বাংলা বাস্তবায়নের ম্যান্ডেট চান বঙ্গবন্ধু

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)

লাখ লাখ মানুষের প্রাণঢালা সংবর্ধনায় নির্বাচনি গণসংযোগের প্রথম দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনা হবে। তিনি বলেন, সোনার বাংলা আমার জীবনের স্বপ্ন। সারা জীবন এজন্য সংগ্রাম করেছি। এখন সেই সোনার বাংলা বাস্তবায়নে আপনাদের ম্যান্ডেট চাই। তিনি বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে ভরাডুবি নিশ্চিত জেনে নির্বাচন বর্জনের ষড়যন্ত্র করছে।

গণসংযোগকালে বঙ্গবন্ধু যেখানেই গেছেন সেখানেই জনগণের মধ্যে ব্যাপক উন্মাদনা প্রকাশ পায়। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরেন। আটক বাঙালি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাকিস্তানের ধ্বংসযজ্ঞ ও জাতির পুনর্গঠন বিষয়ে জোর দেন তিনি। বিশাল জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, যদি ছয় দফা বাস্তবায়ন না হয় তাহলে এক দফা বাস্তবায়িত হবে এবং তিনি তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছেন।

প্রয়োজনে আবারও সংগঠিত হবে মানুষ

বঙ্গবন্ধু নির্বাচনি ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে সাড়ে সাত কোটি মানুষ আবার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করবে। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের পাকিস্তানিদের ধ্বংসযজ্ঞ যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে সরকার কর্তৃক গৃহীত বিষয়গুলো উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, জনগণের স্বার্থে তার ফাঁসির মঞ্চ পছন্দ। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনির মধ্যে তিনি ঘোষণা করেন, তার সরকার পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনবে।

ষড়যন্ত্রকারীরা নির্বাচন বর্জন চায়

বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঈশ্বরগঞ্জে এক বিশাল জনসভায় বলেন, কিছু রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিচ্ছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ যে নির্বাচনে ভরাডুবি, সেই কথা জেনে তারা নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, নির্বাচন বয়কটের যারা হুমকি দিচ্ছে জনগণের স্বার্থে জনগণের কাজে কোনও দিন তাদের দেখা পাওয়া যায়নি। তাদের লক্ষ্য নেতিবাচক কথা প্রচার করে বাংলাদেশকে বৈদেশিক সাহায্য থেকে বঞ্চিত করা। আসলে নির্বাচনে ভরাডুবির আতঙ্কে তারা নির্বাচন বয়কট করতে চায়।

কোথাও মাথা নত করিনি

বঙ্গবন্ধু বলেন, সোনার বাংলার স্বপ্নের জন্য আমাকে যখন ফাঁসির কাষ্ঠে পাঠানো হচ্ছিল, তখনও আমি মাথা নত করিনি। বাংলাদেশের মানুষও পাকিস্তানি হানাদারের কাছে মাথা নত করেননি। তিনি বলেন, এ দেশে মীরজাফররা না থাকলে জনগণের দুর্ভোগ ও নির্যাতন কম হতো। রক্ত ও মৃত্যুর পরিমাণ ও সংখ্যা এত বেশি হতো না। ২৫ বছর ধরে এ দেশের সম্পদ লুটে নিতে তারা পাকিস্তানি শাসকদের সাহায্য করেছে।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের জনগণকে মনে রাখবে

এর আগে জামালপুরে এক বিশাল জনসভায় ভাষণদানকালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের ও মুক্তিবাহিনীর ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা যখন তাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল, আড়াই লাখ মা বোনের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে, তখন গোটা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছিল। তখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে জাতীয় মুক্তি-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে যে শিক্ষা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পেয়েছে, তারা সারা জীবন মনে রাখবে।

বিরোধী দলগুলোর প্রতি বঙ্গবন্ধু

বিরোধী দলগুলোর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, বেশি কথা বলে লাভ কী? নির্বাচনের ময়দানে এলেই সব শেষ হয়ে যাবে। আসন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে বঙ্গবন্ধু জনসমাজের কাছে জানতে চান তার প্রতি তাদের আস্থা আছে কিনা এবং নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন কিনা। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে দুই হাত তুলে তাকে সমর্থন জানান উপস্থিত জনতা।

বাঙালিরা নিমকহারাম নয়

বঙ্গবন্ধু বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দিল্লিতে বসে দিনের পর দিন ইন্দিরা গান্ধীর খানা খাওয়া হয়েছিল যখন তখন লজ্জা হয়নি। তিনি বলেন, সেই দুর্দিনে ১ কোটি লোককে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাত্মক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। তিনি বলেন, দেশের আয়তনের তুলনায় বাঙালিরা ছোট হতে পারে কিন্তু তারা নিমকহারাম নয়। বাংলাদেশে তখনও ভারতের সৈন্য রয়েছে বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার জবাবে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ঘোষণা করেন, ভারতের কোনও সৈন্য দেশে নেই। তিনি বলেন, রাখার প্রয়োজন আমার নেই। সাড়ে সাত কোটি লোক বাংলার স্বাধীনতা রক্ষায় যথেষ্ট।