বিদেশি সাহায্য নেবো, তবে স্বাধীনতা বিকিয়ে নয়: বঙ্গবন্ধু

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)

১৯৭৩ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদা এবং স্বাধীনতার বিনিময়ে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করবেন না। নেত্রকোনায় এক নির্বাচনি জনসভায় বক্তৃতাকালে বঙ্গবন্ধু বলেন,  ‘পুনর্গঠনের জন্য বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করবো বটে, তবে তা জাতীয় মর্যাদা এবং স্বাধীনতার বিনিময়ে নয়।’ সভায় এত বিপুল জনসমাগম হয় যে, আশপাশের উঁচু এলাকাতেও লোকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, আশপাশের গাছপালায় লোকভর্তি হয়ে যায়। তিনি দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, সাহায্যের জন্য ধরনা দেওয়া সম্মানজনক নয়। তাই দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তিনি বলেন, ‘কঠোর পরিশ্রম ভিন্ন অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়।’ বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শুরুর আগে কলেজের একটি ঘরের টিনের চালে বিপুল সংখ্যক লোক ওঠায় তা ধসে পড়ে। টিনের চাল ধসে পড়ায় প্রায় একশ’ আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে হয় বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী মঞ্চ থেকে এই দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। বক্তৃতাকালে তিনি আহতদের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেন। শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান সভায় বক্তৃতা করেন।

বাংলাদেশ অবজারভার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩বঙ্গবন্ধু যে বিষয়গুলো উল্লেখ করেন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,  ‘জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই ৭ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনসাধারণ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন।’ একপর্যায়ে জনসাধারণ হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেন। বিরোধী দলগুলো সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন যে, এসব দলের কোনও কর্মসূচি নেই। খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন, তিনি প্রায় একশ’ কোটি টাকার খাদ্য সংগ্রহের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু সমাজবিরোধী দুষ্কৃতকারীদের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এবং তাদের নির্মূল করার জন্য জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি পুনরায় জোর দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের যুদ্ধ অপরাধীদের বিচার বাংলার মাটিতে অবশ্যই হবে। পাকিস্তানিরা ইতিহাসের সর্বাধিক জঘন্যতম বর্বর অপরাধ করেছে।’ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটক চার লাখ বাঙালির কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘তাদের বাংলাদেশে অবশ্যই ফিরিয়ে আনা হবে।’

ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকুন

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সরকার দেশের তরুণ বংশধরদের উন্নত ও সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করছে।’ বঙ্গবন্ধু জানান, জনগণকে তিনি ধোঁকা দেওয়ায় বিশ্বাসী নন। ভবিষ্যতেও জনগণকে কষ্ট করতে হবে। ছেলেমেয়েদের সুখী ভবিষ্যতের জন্য তাদের বৃহত্তর ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, ‘এ অঞ্চলের জনগণ তিন জন আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন।’ জনগণের প্রতি তিনি দেশের স্বার্থে বিচার-বিবেচনা করে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানান। কিশোরগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে এসব কথা বলেন।

উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষা প্রচলনে সহযোগিতা করুন

উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে মাতৃভাষায় ব্যাপক প্রচলনে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের নতুন পরিভাষা ও প্রতিশব্দ বের করার জন্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ভাষাতত্ত্ববিদদের প্রতি আহ্বান জানান। রাষ্ট্রপতি চৌধুরী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার শীর্ষক চার দিনব্যাপী এক আলোচনা সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘উচ্চতর এবং আদর্শ শিক্ষা কেবল মাতৃভাষাতেই নেওয়া সম্ভব।’

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩গুটিবসন্তের সঙ্গে শিশুদের হাম

রাজধানী ঢাকা শহরে গুটিবসন্তের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের মধ্যে হাম প্রকটভাবে দেখা দেয়। এদিন পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হয়ে শহরে প্রতিদিন গড়ে ৬/৭টি শিশু মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। প্রথমে সামান্য জ্বর, তারপর শরীরে ব্যথা, এরপর সারা দেহে হামের প্রাদুর্ভাব। এটাই এই রোগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কেবল শিশুদের মধ্যে বর্তমানে এই রোগের প্রকোপ দেখা গিয়েছিল।

শহরের প্রায় সবক’টি বস্তি এলাকায় হামের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। শহরের অধিকাংশ আবাসিক এলাকায় কোনও না কোনও বাড়িতে একজন না একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী ছিল। আজিমপুর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, জুরাইনসহ ঢাকার বেশ কয়েকটি স্থানে প্রতিদিন হাম রোগে মৃত শিশুকে কবর দেওয়ার খবর শঙ্কার সৃষ্টি করে।