সবার সুখী ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করাই বঙ্গবন্ধুর একমাত্র লক্ষ্য

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনে ঘোষণা করেন—বাংলাদেশের জনগণের সুখী ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা বিধানই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কারণ, তারা দেশমাতৃকার সন্তান।’ গণসংযোগ সফরের তৃতীয় পর্যায়ে এই দিনে রাঙ্গামাটি, ফেনী  ও লক্ষ্মীপুরে অনুষ্ঠিত তিনটি জনসভায় বঙ্গবন্ধু এসব কথা বলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ তা তারা দেশের যে এলাকারই হোক না কেন, সবাই সমান।’ এবং তিনি তাদের সমানভাবে ভালোবাসেন। এদিন বাসস ও এনা পরিবেশিত খবরে বলা হয়,  প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটিবাসীর কাছে বলেন, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকরা তাদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারে বৈষম্য করতো। আমার কাছে তারা বাঙালিদের মতোই এবং সকলেই মাতৃভূমির সন্তান।’

বাংলাদেশ অবজারভার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন ঘোষণা

জনসভাস্থল থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে জনতা ঘোষণা দেয় যে, তারা তিন বছর কোনও কিছু চাইবে না। জনগণের দুঃখ ও কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার এরইমধ্যে যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে এবং নিচ্ছে বঙ্গবন্ধু তার উল্লেখ করেন এবং ঘোষণা করেন, ৩০ লাখ শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। সুতরাং, দেশের প্রত্যেকটি মানুষকে এ জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেককেই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং এর কোনও বিকল্প নেই।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘উৎপাদন বাড়াতে হবে। কলকারখানা ও ক্ষেত-খামারে উৎপাদন না বাড়ানো পর্যন্ত আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব না।’ দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা অটুট রাখার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু দুষ্কৃতকারী, চোর-ডাকাতদের প্রতিরোধ করতে জনগণের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন।

সকলকে সমান ভালোবাসেন, জানালেন বঙ্গবন্ধু

রাঙামাটিতে এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ জনসভা হয়েছিল ১৯৭৩ সালের এই দিন। বাসসের খবরে প্রকাশ, রাঙামাটিতে এই দিনে অনুষ্ঠিত এযাবৎকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশি সবাই সমান নাগরিক। তারা সমান অধিকার ভোগ করবে। সংবিধানে এর নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।’ পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসকরা তাদের উপজাতি হিসেবে গণ্য করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের  মর্যাদা দিতো। কিন্তু বাংলাদেশ তাদের সমান অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার গ্যারান্টি দিয়ে বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেছে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সকলেই বাংলা মায়ের সন্তান। তারা জঙ্গলে থাকুক বা পাহাড়ের উপত্যকায় বা সমুদ্রের ধারে যেখানে থাকুক, কিছু যায় আসে না।’ পার্বত্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের ভাগ্য নিয়ে যারা খেলা করার প্রয়াস পেতে পারে, তাদের উদ্দেশে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এতে তাদের নিজেদের কোনও মঙ্গল হবে না, বরং এতে স্পষ্টভাবেই তারা দেশের অমঙ্গল করবেন।’

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩পার্বত্য অঞ্চলের জীবনধারা বিঘ্নিত হবে না

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জনসভায় বলেন, ‘পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের জীবনধারা ও রীতিনীতি বিঘ্নিত হবে না। তাদের জীবনধারায় কারও হস্তক্ষেপ করা চলবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাদের প্রতি কখনও যদি কোনোরকম অবিচার করা হয়ে থাকে, তিনি স্বয়ং তার বিরুদ্ধে লড়বেন। কেননা, তিনি সব সময়ই জনগণের ওপর অবিচারের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছেন।’

লক্ষ্মীপুরে ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু

নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দিনে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তিনি সম্ভাব্য সবচাইতে কম সময়ের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র দিয়েছেন এবং নির্বাচনের বন্দোবস্ত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বহু দল ভোট চাইতে ময়দানে নেমেছে, তারা যদি ভোট না পায়, আর জনগণ যদি তাকেই ভোট দেয়, সেটা তাঁর দোষ হবে না। আপনারা যদি আমাকে ভোট দেন, সেটা কি আমার দোষ হবে, তিনি প্রশ্ন করেন।’ সভায় উপস্থিত সবাই বলে ওঠেন না না এবং  জিন্দাবাদ ধ্বনিতে বঙ্গবন্ধুর চারপাশ ভরে ওঠে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কিছু লোক বুঝতে পেরেছে যে তারা ভোট পাবে না। তাই তারা এখন চরম পরাজয় এড়াতে নির্বাচন থেকে পিঠটান দেওয়ার অজুহাত খোঁজার চেষ্টা করছে। পরাজয় এড়াতে কোনও একপর্যায়ে তারা বয়কট ঘোষণাও করতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘কিছু লোক আছে যাদের কোনও নীতি নেই। প্রায়ই দল পরিবর্তন করে।’

বিপত্তি কাটিয়ে রাতেই ঢাকায় ফেরেন বঙ্গবন্ধু

এদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ বঙ্গবন্ধু পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলায় একদিনের নির্বাচনি সফর শেষে ঢাকায় ফিরে আসেন। ঝড়-বৃষ্টির জন্য তাঁর ঢাকায় ফিরতে দুই ঘণ্টা দেরি হয়েছিল। সেই দিন ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশে রাঙামাটি ত্যাগ করেন। কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় কিছুক্ষণ পরই তাঁকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি নোয়াখালী জেলার লক্ষ্মীপুরের চর রুহিতন গ্রামে জরুরি অবতরণ করে।

দৈনিক বাংলা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩পাকিস্তানের মানচিত্রের ফাটল

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা মুখ্যমন্ত্রী মাওলানা মুফতি মাহমুদের নেতৃত্বে গঠিত পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মন্ত্রিসভা এদিন রাতে পদত্যাগ করে। বিবিসির খবরে প্রকাশ, প্রেসিডেন্ট ভুট্টো কর্তৃক প্রাদেশিক গভর্নর আরবাব সিকান্দার খান খলিলকে বরখাস্তের প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামপন্থী প্রাদেশিক গভর্নরের ৭ জনের মধ্যে ৬ জন উপদেষ্টাও তাদের পদত্যাগপত্র পেশ করেন। প্রেসিডেন্ট ভুট্টো কর্তৃক বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ খান মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করার পর সীমান্ত প্রদেশের মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। এর আগে মাঝে মাঝে নির্দেশাবলি পালনে ব্যর্থতার জন্য ভুট্টো সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের গভর্নরকে বরখাস্ত করেন।