বাংলাদেশের ভালোবাসা নিয়ে যেন আমার মৃত্যু হয়: বঙ্গবন্ধু

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)

‘স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ ও রক্তদানের পর জনগণের চরিত্রের কেন পরিবর্তন হবে না, সরকারি কর্মচারীরা কেন ঘুষ খাবে ও দুর্নীতি করবে’—প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, চুরি, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ না করলে একটা ঝড় উঠতে পারে। সেই ঝড়ে অনেকেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। স্বাধীনতার ৯ মাসে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। গণতন্ত্র চাই বলে নির্বাচন দিয়েছি। বাঙালি আমার জাতি। বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার ভাষা। বাংলাদেশের ভালোবাসা নিয়ে যেন আমার মৃত্যু হয়।’

১৯৭৩ সালের এই দিনে চাঁদপুরের হেলিপোর্টে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘জাতির ইজ্জতের বিনিময়ে আমি ভিক্ষা করতে পারবো না। পরের কাছে ভিক্ষা করে কোনও জাতি কখনও মর্যাদা লাভ করতে পারে না।’

সম্পদের সুষম বণ্টনই লক্ষ্য

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনসভায় বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আকাশচুম্বী ওয়াদা দিয়ে আমি জনগণকে ধোঁকা দিতে পারবো না।’ উপস্থিত জনসমুদ্রকে উদ্দেশ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ওপরে আস্থা আছে কিনা, জানতে চাইলে বিশাল জনসমুদ্র দুই হাত তুলে বঙ্গবন্ধুর ওপরে তাদের আস্থার কথা জানিয়ে দেয়। জবাবে প্রধানমন্ত্রী  বলেন, ‘অবস্থা বেগতিক দেখে অনেকে বেকায়দায় পড়ে গেছেন। তাই কেউ কেউ নির্বাচন বর্জনের কথা বলতে শুরু করেছেন। তাদের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, নির্বাচনে তারা একটি আসনও পাবে কিনা।’

দি বাংলাদেশ অবজারভার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে আনন্দমুখর এলাকাবাসী

চাঁদপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত  জনসভার শুরুতে চাঁদপুরবাসীর পক্ষ থেকে জাতির জনকের উদ্দেশে মানপত্র পাঠ করেন তথ্য ও বেতার দফতরের মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু সমবেত জনতার উদ্দেশে ১৭ মিনিট বক্তৃতা দেন। এ সময় মঞ্চে পানিসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ উপবিষ্ট ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কিছু দূর থেকে হেঁটে আসতে থাকলে জনগণ তুমুল করতালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানায়। হাজার মানুষের কণ্ঠে ‘বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ’, ‘বঙ্গবন্ধু যেখানে আমরা আছি সেখানে’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’ স্লোগানে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা বঙ্গবন্ধুকে এ সময়  পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন ।

এর আগে সকালে সিলেট হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারতের পর বঙ্গবন্ধু মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুটি জনসভায় ভাষণ দেন। তিনটার দিকে হেলিকপ্টারে তিনি চাঁদপুর আগমন করেন এবং সেখানে পৌঁছালে সমবেত জনতা প্রিয় নেতাকে হেলিকপ্টারে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েন।

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘চলতি বছরে বিদেশ থেকে ছয়শ’ কোটি টাকার খাবার কিনতে হয়েছে। তাই এরপর দেশবাসীকে কী দিতে পারবো, না পারবো, তা এখনই আমি বলতে পারছি না। পাকিস্তানি শোষকরা বাংলাদেশকে সর্বস্বান্ত করে দিয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনই কষ্টসাধ্য।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর ভারত যদি বাংলাদেশকে খাবার সাহায্য না দিতো, তাহলে আমি দেশবাসীকে বাঁচাতে পারতাম না। অথচ এখন কেউ কেউ বন্ধু দেশ ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলাকে একটি ফ্যাশনে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ-ভারত দুটি প্রতিবেশী স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। কেউ কারও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। উভয় দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি পূর্ণ মর্যাদা রেখেই বন্ধুত্ব অটুট থাকবে।’ প্রধানমন্ত্রী পুনরায় বলেন, ‘দেশের মানুষ যদি পেট ভরে খেতে না পায় ও সম্পদের সুষম বণ্টন যদি না হয়, তাহলে বহুমূল্যে অর্জিত এই স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।’

দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনসভায় বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত জনসভায় বলেন, ‘ভবিষ্যতে কী ঘটবে জানি না, তবে আমি দেশে একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরুর নিশ্চয়তা বিধান করতে চাই।’ মৌলভীবাজার থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়ে স্থানীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘দেশকে যে সংবিধান দেওয়া হয়েছে, তাতে জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যগুলো অর্জনে জনগণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে।’ এত শিগগিরই একটি সংবিধান দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ মরণশীল, তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এমন একটা অবস্থা দেখে যেতে চান, যেখানে জনগণের অগ্রগতি, সমৃদ্ধি ও নতুন দেশের শাসন কাজ পরিচালিত হবে। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, তিনি কখনও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেননি। কোনোরকম ভিত্তি ছাড়া প্রতিশ্রুতি দেওয়া তার স্বভাব নয়।

দৈনিক বাংলা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩বাংলাদেশ-ভারত ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী হয়ে থাকবে

শেখ মুজিবুর রহমান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভারতের নিন্দা করা কিছু লোকের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাঙালিরা অকৃতজ্ঞ জাতি নয়।’ তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার এবং পরস্পরের সার্বভৌমত্বের মর্যাদা দেওয়ার নীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশ এবং ভারত দুই ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী এবং ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে। স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দেওয়ার জন্য তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, তাঁর সহকর্মী এবং দেশটির জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।