‘গণমানুষের সেবাই আমার রাজনীতি’

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।)

বাংলার শোষিত ও নির্যাতিত লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষের সেবা, তাদের নিরানন্দ জীবনে আনন্দের জোয়ার সৃষ্টি ও মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা আমার রাজনীতির লক্ষ্য। ক্ষুধার্ত দেশবাসীর মুখে অন্ন, বস্ত্রহীনের লজ্জা নিবারণের মতো পর্যাপ্ত বস্ত্র এবং নিরাপদ আশ্রয়ের সংস্থানের জন্য আমি রাজনীতি করছি। ১৯৭৩ সালের এইদিনে মাদারীপুর, ঝালকাঠি, বাকেরগঞ্জ এলাকায় নির্বাচনি সফরে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব কথা বলেন।

তিনি জনসভায় ভাষণদানকালে বলেন, ক্ষমতা দখল করা বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নয়; বরং জনগণের সেবা করার জন্যই আমি রাজনীতি করি। আইন মান্যকারী শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের শান্তি ভঙ্গকারী সমাজবিরোধীদের নির্মূল করার ব্যাপারে সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

শোষণহীন সমাজ গঠনের আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তার সারা জীবনের স্বপ্ন এ দেশকে সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা করে গড়ে তোলার জন্য শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলা দুঃখী মানুষের জন্য যদি খাদ্য না জোটে, পরনের কাপড় যদি না জোটে, থাকার ঘর যদি না জোটে, তাহলে তারা জীবনের স্বপ্ন সোনার বাংলা কোনও দিন সম্ভব হবে না। সুখী সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। চরম আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে দেশ গড়ার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির সম্পদ আর কেউ লুট করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনও দেশই আর বাংলাদেশের সম্পদ লুটে নিয়ে যেতে পারবে না। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। জাতিকে তিনি এই বলে সতর্ক করে দেন যে, কিছু লোক বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের চোখে বাঙালি জাতির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার এবং ভাবমূর্তি খাটো করার অপচেষ্টায় তৎপর রয়েছে। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে সঠিক জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনে জনগণের দায়িত্ব ও ভূমিকার ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু পুনর্বার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, নির্বাচন হবে অবাধ ও নিরপেক্ষ। জনগণ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে তাদের পছন্দ মতো প্রার্থী নির্বাচন করতে পারবে। ভোটদাতাদের জন্য ব্যালট বাক্স থাকবে। আর ভোটদাতারা তাদের পছন্দ মতো প্রার্থীকে এবারের বাক্সে অবাধে ভোট দিতে পারবেন এবং এতে কোনও হস্তক্ষেপ করা হবে না।

সমাজবিরোধীদের রুখে দিন

প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বলেন, দেশকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তানি হানাদারের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যেসব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা লড়াই করেছিল, তারা তার আহ্বানে অস্ত্র জমা দিয়েছেন কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক যারা আলবদর এবং রাজাকার, তাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়নি। এসব লোক সমাজের শান্তি বিঘ্নিত করে ডাকাতি এবং অন্যান্য সমাজবিরোধী কাজ করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিহত করার দায়িত্বে নিয়োজিত রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ প্রত্যাহার করা হবে না। সরকার সমাজের শান্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য ডাকাত ও অন্যান্য সমাজ বিরোধীদের নির্মূল করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সমাজ বিরোধীদের নির্মূল করার জন্য তিনি জনগণের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

বাকেরগঞ্জের জনসভায় বঙ্গবন্ধু

বাকেরগঞ্জ থানা সদরে এক বিশাল জনসমুদ্রে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, পৃথিবীর কোনও দেশ আর বাংলাদেশের সম্পদ লুটে নিয়ে যেতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু বলেন, জাতি আজ এমন এক সংবিধান লাভ করেছে, যাতে জনগণের মৌলিক অধিকারের গ্যারান্টি রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের বিগত ২৫ বছরের শাসনামলে তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করেছে। উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার আগেই শতাব্দী ধরে ইংরেজরা এ দেশকে শাসন করেছে। পাকিস্তানিরা তাদের ২৫ বছরের দুঃশাসনের সময় বাংলাদেশের সকল বৈদেশিক মুদ্রা লুণ্ঠন করেছে।

মাদারীপুরের জনসভায় বঙ্গবন্ধু

মাদারীপুর থেকে সংবাদদাতারা জানান, মাদারীপুর জুটমিল মাঠে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, কিছু লোক মিথ্যা বানোয়াট কাহিনী রচনা, অপপ্রচার এবং বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে বাংলাদেশের মর্যাদা নষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। জনগণ তাকে এবং তার দলকে সমর্থন করে কিনা, তার নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা, নির্বাচনের ফল থেকে বিশ্ববাসী তা প্রত্যক্ষ করবে।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান শাসনামলে সীমাহীন শোষণ ও এ দেশের সম্পদ বণ্টনের কথা উল্লেখ করে বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশের অর্থনীতিকে গুঁড়ো করে দিয়ে গেছে। তিনি বলেন, তার সরকার দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনাহার থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বঙ্গবন্ধু দেশে শিল্প কারখানা এবং কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শ্রমিক-কৃষক এবং সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তির প্রতি আহ্বান জানান। দেশবাসীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি শুধু আপনাদের কাছ থেকে ভোট চাই না, আমি চাই এ দেশকে আপনারা কঠোর পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করবেন। সমাজবিরোধীদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, তার দলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের অনেকেই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।