বিদায়ের চেয়ে বরণ উদযাপনই বেশি

পুরনো দিন চলে যায়, আসে নতুন ভোর। নতুনকে স্বাগত জানানোর রেওয়াজ ও আয়োজন হয় বেশি। শুধু এদেশেই নয়, বিশ্বের সবদেশেই নতুনকে বরণ করা হয় ঘটা করে। কিন্তু পুরনোকে বিদায় জানাতে বড়মাপের আয়োজন তেমন একটা দেখা যায় না। যদিও আমাদের দেশে পালন করা হয় দুটোই, তবে চৈত্র সংক্রান্তির তুলনায় নববর্ষে পহেলা বৈশাখ নিয়ে আয়োজন থাকে বেশি। চৈত্র সংক্রান্তিতে বিদায় জানানো হয় পুরনো বাংলা বর্ষকে, আর  পহেলা বৈশাখে বরণ করা হয়। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, পালন হয় দুটোই, কিন্তু বরণকে উদযাপন করা হয় বেশি।

বাংলা বছরের শেষ দিন পালন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। বসন্তকে বিদায় জানাতে না জানাতেই প্রস্তুতি নিতে হয় বর্ষবরণের। চৈত্র থেকে বর্ষার আগ পর্যন্ত যখন প্রচণ্ড উত্তাপ থাকে সূর্যের, তখন সেই তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ বহু অতীতে চৈত্র সংক্রান্তির উদ্ভাবন করেছিল। আবহমান বাংলার চিরায়ত নানা ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে এই চৈত্র সংক্রান্তি। বছরের শেষ দিন হিসেবে পুরনোকে বিদায় ও নতুন বর্ষকে বরণ করার জন্য প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিকে ঘিরে থাকে নানা অনুষ্ঠান-উৎসবের আয়োজন।  চৈত্র সংক্রান্তিকে অনুসরণ করেই পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এত আয়োজন। তাই চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে বাঙালির আরেক বড় উৎসব।  

কৃষিকাজ ও খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য বাংলা সাল গণনা শুরু হয়েছিল মোঘল সম্রাট আকবরের আমলে। হিজরি চন্দ্র সাল ও বাংলা সৌর সালের ওপর ভিত্তি করে প্রবর্তিত হয় নতুন এই বাংলা সাল। ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সাল প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সাল নামে, পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলা বর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে ছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নববর্ষ উদযাপন পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সর্বজনীন উৎসবে। পহেলা বৈশাখের ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ফাজরীন হুদা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের এখানে বিদায় এবং বরণ দুটোই পালন করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে কিছুটা সম্পর্কিত। তারা সেভাবেই বিদায় জানায়। তাদের কিছু রীতি আছে। যেমন- তারা কিন্তু পহেলা বৈশাখের আগে আম খায় না। পহেলা বৈশাখে পুজা করে তারপর আম খায় তারা। সেসবের মধ্যে দিয়ে জিনিসগুলো এসেছে। নতুন একটা বছর যেহেতু আসছে, সে কারণে চৈত্র সংক্রান্তিতে সেটিকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করা। বিদায়কে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি না, বা নতুন বছরকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি ব্যাপারটা তা নয়। এটি একটি ট্রানজিশনের বিষয়। পুরনোটাকে বিদায় দিয়ে একটা রীতির মাধ্যমে নতুন বছরকে আরেকটি রীতির মাধ্যমে বরণ করি আমরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধানের সঙ্গে কিংবা কৃষির সঙ্গে একটা সম্পর্ক আছে। সম্রাট আকবর কিন্তু এটিকে  চন্দ্র মাস এবং সূর্য মাসের সঙ্গে সমন্বয় করে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ঠিক করেছিলেন। একটি বছরকে বিদায় দিয়ে আরেকটি নতুন বছরকে রীতির মাধ্যমে গ্রহণ করা কিন্তু শুধু বাংলাতেই হয় না, উপমহাদেশের পাঞ্জাবেও হয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে আমাদের ভৌগোলিক কাঠামোর বেশ মিল আছে। পাঞ্জাবে বেশ বড় করে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়। পাঞ্জাব একটি কৃষিভিত্তিক দেশ, বিহার উড়িষ্যার ওদিকে খুব একটা হয় না। আমাদের রীতিগুলো ফসল সম্পর্কিত। ফসল কীভাবে হয়, সেই অনুযায়ী রীতিগুলো করা হয়েছে।’

রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ মনে করেন, বরণটাকেই বেশি পালন করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির পর পয়লা বৈশাখ অনেক বড় হয়ে আসে। আর মানুষের ধর্মই হচ্ছে—নতুন কোনও কিছুর দিকে আকর্ষণ বেশি থাকা। পুরনোকে হারানোর বেদনা থাকে। আমরা প্যাশনের দিকে তাকাই ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি তাকাই নতুন কী হচ্ছে, তার দিকে।’