বঙ্গবন্ধুর বিদেশ সফরের আগেই পাক-ভারত বৈঠক

(বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারি কর্মকাণ্ড ও তার শাসনামল নিয়ে মুজিববর্ষ উপলক্ষে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বাংলা ট্রিবিউন। আজ পড়ুন ১৯৭৩ সালের ৮ জুলাইয়ের  ঘটনা।)

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পিএন হাকসার ইঙ্গিত দেন যে, ২৭ জুলাইয়ের  মধ্যে প্রস্তাবিত পাক-ভারত আলোচনা অনুষ্ঠিত হতে পারে। যদিও পাকিস্তান সর্বশেষ ২৮ জুলাই তারিখে আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দিয়েছে। এই তারিখ সম্পর্কে হাকসার বলেন যে, ‘ভারতের জন্য সেই তারিখ সুবিধাজনক হবে না। কারণ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন যুগোস্লাভিয়া ও কানাডা সফরে বিদেশে অবস্থান করবেন এবং পরামর্শের জন্য তাকে পাওয়া যাবে না। অপরদিকে, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন। বঙ্গবন্ধু ২৭ জুলাই তার সফর শুরু করবেন। ফলে এর মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে না। বাংলাদেশ-ভারতের জন্য অনুকূল হয়— এমন দিনে আলোচনা হবে।’ হাকসার নয়াদিল্লির উদ্দেশে কলকাতা রওনা হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন বলে জানানো হয়। এর আগে তিনি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন।

বাংলাদেশ মধ্যস্থতার পক্ষপাতি নয়

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এদিন বলেন যে, ‘উপমহাদেশের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় পক্ষপাতি। বাংলাদেশ কোনও প্রকার মধ্যস্থতায় পক্ষপাতি নয়।’ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি দেশ সফরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের আগেই বিমানবন্দরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত উপমহাদেশের মানবিক সমস্যাবলীর সমাধান আন্তরিকভাবে কামনা করে। কিন্তু এখন সবকিছুই পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করছে।’ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশ সফরে তিনি কলকাতা হয়ে প্রথমে ইন্দোনেশিয়া যাবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উপমহাদেশের সম্পর্কে তিনি ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদম মালিকের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন। তবে কোনও মধ্যস্থতার প্রশ্ন নয়, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্বাসী।’

দৈনিক বাংলা, ৯ জুলাই ১৯৭৩বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক জোরদার করতে তার এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি উল্লেখ করেন। ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘অতীতে পাকিস্তান নিকট প্রতিবেশী দেশ থেকে আমাদের দূরে রেখেছিল। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে তার নিকট-প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে,  তার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বার্মা ও উত্তর ভিয়েতনাম সফরের ফলে এসব দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।’

গণভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠক

এ দিন গণভবনে মন্ত্রিসভার এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠক টানা চার ঘণ্টা চলে। দেশে না থাকার কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী জহুর আহমেদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন না। এই দুজন ব্যতীত সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

নদীর পানি ভাগাভাগি

বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে বন্যা সমস্যা ও ভারত-বাংলাদেশ সাধারণ নদীগুলোর পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পিএন হাকসারের আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। পিএন হাসকার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়াও পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি কমিশনার নুরুল ইসলাম, জেনারেল এম এ জি ওসমানী, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ ও শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ডেইল অবজারভার, ৯ জুলাই ১৯৭৩এদিকে ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পুরনো ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা,গড়াই, সুরমা-কুশিয়ারাসহ সব জায়গায় পানি বিপদ সীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চাঁদপুরের মেঘনায় পানি গতকাল সকাল থেকে কমতে শুরু করে।

শিগগিরই নতুন বেতন হার ঘোষণা

কর্মচারীদের একাংশের নতুন বেতন হার শিগগিরই ঘোষণা করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ জানান। তবে যখনই তা ঘোষণা করা হোক না কেন, ১৯৭৩ সালের পহেলা জুলাই থেকে তা কার্যকর করা হবে। বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ ধ্বনি তুলে এ কথা ঘোষণা করেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষক সম্মেলনে ভাষণদানকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রিপরিষদ বেতন কমিশনের রিপোর্ট বিবেচনা সমাপ্ত করেছে।’ তিনি ঘোষণা করেন, এ সরকার গঠিত কমিশনের সকল রিপোর্ট প্রকাশ করবে। অতীতের ন্যায় আর একটিও অপ্রকাশিত থাকবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এখন সরকারি কর্মচারী— একথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘তারা সরকারি চাকুরের সব রকম সুবিধা ভোগ করবেন।’ তিনি আরও বলেন যে, ‘শিক্ষকরা অবসর গ্রহণ করবেন। তাদের সকলকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার উপায় উদ্ভাবন করা হচ্ছে।’